বাতাসে ভাসছে শিউলির গন্ধ, কাশের দোলানি জানান দিচ্ছে , মা আসছে। চারিদিকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে উমা আসার ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা অনেক সময় হারিয়ে ফেলি বাংলার নানান প্রাচীন দুর্গাপুজোর ইতিহাস। হারিয়ে ফেলি সাবেকিয়ানায় মোড়া সেইসব দালান,সেই প্রতিমা, ধুনোর গন্ধ, বিসর্জনের নাচ, সাপুড়েদের পুতুল খেলা, নাড়ু চুরি, অষ্টমীর দুপুরে লুচির গন্ধ ও এরকম আরও কত কি! তবুও হাওড়া জেলার গ্রামাঞ্চলে যে সমস্ত প্রাচীন বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোগুলো এখনও পর্যন্ত সেই প্রাচীন প্রথা মেনে ঐতিহ্যের সাথে চলে আসছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পাঁতিহালের রায়বাড়ির দুর্গাপুজো। জগৎবল্লভপুর থানার অন্তর্গত পাঁতিহাল গ্রামের এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ইতিহাস।
পুজোর সময় নতুন রঙে সেজে ওঠে রায়েদের দুর্গা দালান। ৩০০ বছর আগে বর্ধমান রাজাদের হাত ধরে শুরু হয় রায় পরিবারের দুর্গা পুজো। একসময় এই পরিবার বর্ধমান রাজপরিবারের অধীনস্থ জমিদার ছিলেন। প্রতিটি বনেদি বাড়ির পুজোতে থাকা নিজস্ব কিছু নিয়ম ও বৈশিষ্ট্যের মত রায় পরিবারের পুজোরও তা বেশ কিছু রয়েছে। জন্মাষ্টমীর সকালে কাঠামো পুজো দিয়ে শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। বোধন বসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ, হয় দুর্গার দশহাজার ও কৃষ্ণের পাঁচশো নাম জপ্। পরদিন অর্থাৎ সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকার স্নানপর্ব। তারপর ঘটস্থাপন করে শুরু হয় মহাপুজো। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী- পুজোর এই এবং সন্ধিপুজোতে পাঁঠাবলি হয়ে থাকে। তখনকার নিয়মে তোপধ্বনির আওয়াজ শুনে শুরু হত সন্ধিপুজো। কালের নিয়মে আজ আর কামান দাগার সেই শব্দ শোনা যায় না।
রায় পরিবারের দুর্গা মূর্তির মুখের আদল তৈরি হয় নিজবালিয়ার দেবী সিংহবাহিনীর আদলে। এখানকার দেবী প্রতিমার অন্যান্য প্রতিমার তুলনায় একটু আলাদা কারণ দেবী দশভূজা নন, তিনি চতুর্ভূজা ত্রিচালা আকৃতির। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, বর্ধমানরাজ বালিয়া পরগনায় সিংহবাহিনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে যাওয়ার সময় রায় পরিবারের দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন। তাই এখনও পর্যন্ত নবমীর দিন সকালবেলায় সিংহবাহিনী মন্দিরে মায়ের পুজো দিয়েই নবমীর পুজো শুরু হয়। সেসময় জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালান মেতে থাকত বহুদূর থেকে আগত প্রজাদের সমাগমে। জমিদার বাড়ির পুজো বলে কথা! হই -হুল্লোর , খাওয়া – দাওয়া, আমোদ – প্রমোদে গম গম করত। সেই জৌলুস আজ বেশ ফিকে হলেও বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সবরকম চেষ্টা করে চলেছেন। জমিদার বাড়িতে এখন অষ্টমীর দুপুরে নিমন্ত্রিত থাকেন সমগ্র এলাকার মানুষেরা। দুঃস্থদের দান করা হয় নতুন বস্ত্র ও অর্থ।
দশমীর দিন সকালে ঠাকুর দালানে ভিড় বাড়ে পাঁতিহাল হাটতলার সাপুড়েদের সাপ খেলা আর পুতুল নাচ দেখার জন্য। “সখী নাচবি, খেঁদী রসের বিনোদি” এই গানে বৃদ্ধ বিনোদিরা নেচে ওঠে। এই পুতুল নাচ ও সাপ খেলা দেখার আলাদাই আকর্ষণ ছিল সেসময়। এমনকি এখনও তারা প্রথা মেনে আয়োজন করে এই খেলার। এবার উমার যাবার পালা! দশমীর সন্ধ্যে থেকেই বাড়ির মহিলারা ভারাক্রান্ত মনে বরণ করেন উমাকে। বাড়ির পুরুষ সদস্যদের কাঁধে চেপে মন্ডলার ঘাটে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি হয় পুজো পর্বের। দুর্গা দালানের পুরনো ঝাড়লন্ঠনের আলো নিভিয়ে আবার শুরু হয় আসছে বছরের অপেক্ষা। প্রতি বছর পুজো আসে, পুজো যায়। আর অতীতের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচীন দুর্গা দালান।
Discussion about this post