শেষ হয়েছে দুর্গা পুজো। আপামর বাঙালির মন ভার করে আবার এক বছরের জন্য কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন দেবী দুর্গা। তবে, দুর্গা পুজো শেষ হতে না হতেই বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গিয়েছে কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনার তোড়জোড়। সারা রাজ্যে মূলত ঘরোয়াভাবেই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো হলেও, হাওড়া জেলার আমতা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত জয়পুর থানার খালনা গ্রামে কিন্তু চিত্রটা একদম অন্যরকম। এই গ্রাম বর্তমানে হয়ে উঠেছে বাংলার লক্ষ্মী পুজোর পীঠস্থান। এই লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর খালনা গ্রাম হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উদাহরণস্বরূপ। প্রাচীন বর্ধিষ্ণু এই গ্রামটির এখন নতুন নাম হয়েছে ‘লক্ষ্মীগ্রাম’।
এই গ্রামের লক্ষ্মী আরাধনা সারা বাংলায় স্বতন্ত্র। জাঁকজমকের দিক থেকে কলকাতার দুর্গা পুজোকেও টক্কর দিতে পারে এই গ্রামের লক্ষ্মী পুজো। তাইতো, বিজয়া দশমী কাটলেই জয়পুরের খালনায় শুরু হয় সাজো-সাজো রব। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা দুর্গা পুজো ছাড়া, এখানে বিশেষ একটা দুর্গা পুজো হয় না। তবে, ২৫০টিরও বেশি লক্ষ্মীপূজো হয় এই গ্রামে। এর মধ্যে ২৫টি বারোয়ারী আর বাকিগুলি ঘরোয়া। তবে সবথেকে অবাক করা বিষয়টা হলো, এই গ্রামটিতে লক্ষ্মীপূজো কিন্তু চার দিনের। প্রথম দিন হয় পুজো, আর পরবর্তী তিনদিন ধরে চলে নানা উৎসব, বসে মেলা। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীর আগমনে মেতে ওঠে এই গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা।
হিন্দু-মুসলিম সবাই এই পুজোয় অংশগ্রহণ করে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করেন। গ্রামের বয়স্করা জানাচ্ছেন, একটা সময়ে এই গ্রামটি অত্যন্ত বন্যাপ্রবণ ছিল। ফি বছর বন্যায় এই গ্রামের সব ফসল নষ্ট হয়ে যেত। ঘরবাড়ি হারাতেন নদীর পাশে বসবাসকারী মানুষজন। তাই এই গ্রামের বাসিন্দারা চাইলেও কৃষিকাজ করতে পারতেন না। অতএব, বাধ্য হয়েই ব্যবসার পথ বেছে নিতে হত সকলকে। এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের চির উপাস্য হলেন শ্রী আর সম্পদের দেবী লক্ষ্মী। গ্রামকে বন্যা থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বণিক সম্প্রদায়ের হাত ধরেই এই গ্রামে পূজিতা হতে শুরু করেন দেবী লক্ষ্মী।
এই পুজো শুরু হওয়ার পর গ্রামে বন্যার প্রকোপ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তাই এই পুজো আর কোনদিন বন্ধ হয়নি। পরের দিকে অবশ্য, বণিক প্রাধান্য কমে গিয়ে ধীরে ধীরে বারোয়ারীর রূপ নিতে শুরু করে এই পুজো। কালের নিয়মে তা পরিণত হয়ে ওঠে উৎসবে। এই উৎসবমুখর লক্ষ্মী পুজো দেখতে দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থীর সমাগম হয় এই গ্রামের পুজো মন্ডপগুলোতে। হাওড়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন এই গ্রামে । সারারাত ধরে দর্শনার্থীদের সমাগম, যেন কলকাতার বড় বড় পুজোগুলোকেও হার মানায়। গোটা গ্রাম জুড়ে তৈরি হয় এক অলৌকিক পরিমন্ডল। তিন দিন ধরে জমজমাট মেলা-পরিবেশে এক কথায় অনন্য, অসাধারণ হয়ে ওঠে খালনা গ্রামের এই লক্ষ্মী আরাধনা।
Discussion about this post