সময়টা ১৯৪২ সাল,বিশ্ব তখন মেতে মানব সভ্যতার সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে’। চারিদিকে মৃত্যু মিছিল। সোভিয়েত জেনারেল অ্যান্ডার্সের এর অধীনে পোলিশ সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় অ্যান্ডার্স আর্মি। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতালিতে মিত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান। চারিদিকে এত হিংসার মাঝেও ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল এক ছোট মা মরা ভালুক ছানা। এই ভালবাসার অধ্যায়ের শুরু ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে। অ্যান্ডার্স আর্মি যখন ইরানের উদ্দেশ্যে হামাদান রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছয়। তারা এক কুর্দী বালকের কাছে পুতুলের মত একটা ভালুক ছানা দেখতে পায়। যার মাকে সম্ভবত শিকারীরা মেরে ফেলেছিল। সেই সময় পোলিশ জেনারেল লুগোজোস্কির ভাইয়ের নাতনী ইরিনা, লেফটেন্যান্ট আনাতোলি তারনোস্কিকে অনুরোধ করে যেন ভালুকের ছানাটি তিনি কিনে নেয়। না হলে হয়ত সেই ভালুক ছানাটা না খেতে পেয়ে মারা যাবে।
তখন লেফটেন্যান্ট ভালুক ছানাটিকে কয়েক টিন মাংস, কিছু ইরানিয়ান টাকা, একটা সুইস নাইফ এবং কিছু চকলেটের বিনিময়ে কিনে নেন। এরপর হামদান শহরের বাইরে উদ্ধাস্তু ক্যাম্পে ইরিনার তত্ত্বাবধানে ভালুক ছানাটি তিন মাস থাকে। তারপর এই ভালুক ছানাটিকে পোলিশ ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এখানেই শুরু হয় তার নতুন জীবন। ধীরে ধীরে পরিবার পরিজনহীন সৈন্যদের মাঝে ভালুক ছানাটি শিশুর মত আদর পেতে শুরু করল। আদর করে নাম রাখা হল ‘ভজটেক’। যার অর্থ ‘হাস্যোজ্জ্বোল যোদ্ধা’। তবে সমস্যা হলো ভজটেকের বয়স মাত্র কয়েক মাস। এ বয়সের ভালুক মায়ের বুকের দুধই খায়। তখন সেনারা ভজটেককে মদের বোতলে কনডেন্সড মিল্ক খাওয়াতে শুরু করেন। এমনকি তখন সে বিয়ারও পান করতে শিখে যায়। সৈন্যদের সাথে সে কুস্তিও লড়ত। একটু বড় হয়ে ভজটেক খেয়াল রাখত তার সাথে কুস্তি লড়াই করা সৈন্য যেন ব্যাথা না পায়। কেউ যদি ব্যাথা পাবার অভিনয় করত তবে ভজটেক তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিত। ভজটেক ২২ তম আর্টিলারির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৪ সালে। ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীকে ইতালীতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ব্রিটিশ নিয়ম অনুযায়ী কোন পোষা প্রাণীকে তাদের যানবাহনে বহন করা নিষেধ। সেনারা ভাবতে শুরু করল কীভাবে ব্রিটিশ নিয়মকে ফাঁকি দেওয়া যায়! বুদ্ধিও বের হয়ে গেল। ভজটেককে পোলিশ আর্মিতে সাধারণ সৈন্যদের ইংরেজীতে ‘প্রাইভেট’ হিসাবে অফিশিয়ালি নিয়োগ দেওয়া হল। যার ফলে ভজটেকের জাহাজে উঠতে আর কোনও বাধা থাকল না।
পোল্যান্ড সেনাবাহিনীর প্রবীণ সেনা উজসিয়েক নারেবস্কি জানান, “ও অনেক শক্তিশালী ছিল। যেখানে এক বাক্স অস্ত্র বহনে ৪ জন সেনা হাঁপিয়ে উঠত সেখানে ও একাই তা মাথায় উঠিয়ে ফেলত। আমাদের কাজ করতে দেখলেই ও নিজে থেকে এসে আমাদের সাহায্য করত।” বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভজটেক সহ ২২ তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানীকে স্কটল্যান্ডের হুটন গ্রামে পাঠানো হয়। সেখানেও স্থানীয়দের মাঝে ভজটেক খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পোলিশ-স্কটিশ অ্যাসোসিয়েশন ভজটেককে তাদের সন্মানিক সদস্যপদে বরণ করে। এরপর তাকে ১৯৪৭ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। এখানে প্রায়ই তার সাথে পোলিশ আর ব্রিটিশ সেনারা দেখা করতে আসত এবং বন্ধুর মত এক সাথে বিয়ার খেয়ে সময় কাটাতেন তারা।
১৯৬৩ সালের ২ ডিসেম্বর ২১ বছর বয়সে ভজটেকের জীবনাবসানের মাধ্যমে শেষ হয় এক স্বার্থহীন ভালবাসার অধ্যায়ের। ভজটেকের মূর্তি স্থাপিত রয়েছে ‘এডিনবার্গ প্রিন্সেস ষ্ট্রীট গার্ডেনে’। ভজটেকের স্মৃতি মিশে রয়েছে পোল্যান্ডের সেনানিবাসের ২২ নম্বর ব্যাটেলিয়নের সদর তোরণে। ভজটেকের এই কাহিনি বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে ‘আ বিয়ার নেমড ভজটেক’ নামে তৈরী হয়েছে এনিমেশান সিনেমাও।
Discussion about this post