কালো সোনা নামটা শুনেই ভাবছেন তো, সোনা আবার কালো হয় নাকি? আলবাত হয়। তবে এই সোনা দিয়ে আপনি গয়না বানাতে পারবেননা। তবে এই ‘ সোনা ‘ ব্যাবহার আপনার খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি হবে নিশ্চিত। আসলে এই কালো সোনা আর অন্য কিছুই নয়, এটা আমাদের অতি পরিচিত গোলমরিচ। কেন গোলমরিচ পেল কালো সোনার আখ্যা, সেই ইতিহাসই আজ আপনাদের জানাব।
এই গোলমরিচ আজকাল পৃথিবীর সব প্রান্তে মেলে । উৎপাদনও হয় অনেক জায়গাতেই। তবে এমন একটা সময়ে ছিল, যখন এটি মূলত আমাদেরই দেশের দক্ষিণ প্রান্তে মিলত সর্বাধিক। অনেক ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ থেকে জানতে পারি যে কেরালায় ছিল মুজিরিস নামের এক বিখ্যাত বন্দর নগরী। যেখান থেকেই প্রাচীনকালে রপ্তানি হত সবচেয়ে বেশী গোলমরিচ। এ সময়ে মশালার ব্যাবসায় এক বিশাল স্থান দখল করেছিল এই গোলমরিচ। এর ব্যাবসা যেমন ছিল লাভজনক , তেমনই এটা ছিল মূল্যবান। আসলে এই অত্যাধিক দামই গোলমরিচকে ‘কালো সোনা’ উপাধি এনে দেয়। জানা যায় প্রাচীন ভারতে এটি কেবল রান্নার উপাদান হিসাবেই পরিচিত ছিল তা কিন্তু নয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরীতে এবং নানারকম ধর্মীয় কাজেও এর বহুল ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া রান্নায় এর ব্যাবহার খাবারে অন্য মাত্রা যোগ করে বলে গোলমরিচকে ‘মশলার রাজাও’ বলা হয়।
মূলত: ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে রোম সাম্রাজ্যের সাথে ভারতের বানিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয় এর হাত ধরেই। ভারত মহাসগরে হওয়া এই বাণিজ্যের বিস্তর বিবরণ মেলে ‘পেরিপ্লাস অফ দা এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে। গ্রীক ভূ-বিদ স্ট্রাবোর মতে এ কাজের জন্য বছরে ১২০টি জাহাজকে ভারতে পাঠানো হত। রোমের দামী খাবারগুলোতে অত্যন্ত প্রচলিত উপাদান হিসাবে যে গোলমরিচেরই ব্যাবহার হতো, একথা আমরা জানতে পারি ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবনের লেখা থেকেই। প্লিনি তাঁর লেখা ন্যাচারাল হিস্ট্রি গ্রন্থে খানিক অভিযোগের সুরেই এক তথ্য দেন। সেখান থেকে জানা যায় যে সেই সময়(৭৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ) এমন কোনো বছর যেত না ,যখন রোম থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন সেসটাস (প্রাচীন রোমান মুদ্রা) ভারতে আসত না। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এটিকে ঘিরে ঠিক কী বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য হত। মরিচ এতটাই দামী ছিল যে সেটাকে অনেক সময় মুদ্রার বিকল্প হিসাবেও ব্যবহার করা হত। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই ব্যাবসা দখল করে প্রথমে পর্সিয়ানরা। পরবর্তীতে তা আরবদের দখলে চলে যায়।
সম্ভবত পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা যখন যখন ভারতে এসেছিলেন, তারপর থেকেই এই মসলা ব্যাবসার আরও উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪৮ সালে মালাবার উপকূলবর্তী কালিকট বন্দরে ভাস্কো দা গামার আগমন ঘটে। যা ইউরোপ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সরাসরি বানিজ্যিক সম্পর্কর সূচনার ইঙ্গিত দেয়। লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ভ্যান ডেরভেন জানিয়েছেন , সেসময় এটি ইউরোপের সামাজ এবং অর্থনীতিতে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে গোলমরিচ আমরা প্রায় সব খাবারেই ব্যাবহার করি তার পিছনে কত বড়ো ইতিহাস লুকিয়ে আছে।ভারতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে আর কোনো মশলা মনেহয় এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। এ যেন সূচনা করেছিল এক বিশ্বায়নের। তাই প্রকৃত অর্থেই আমদের নিত্য প্রয়োজনীয় গোলমরিচ যেন ‘ মশলার রাজা ‘ এই তখ্মা পাওয়ার অধিকারী।
Discussion about this post