শরদিন্দুবাবুর ব্যোমকেশ কে না পড়েছে। রহস্য রোমাঞ্চ খুন আততায়ীর আঁতুড়ঘর সে উপন্যাস। আর বাঙালি তাকে চিরকাল গোগ্রাসে গিলেছে। কিন্তু এবার যা বলতে চলেছি তা না তো উপন্যাস, আর না তো কোনো গাঁয়ের ডাইনির গল্পে পাবেন। বাস্তব সত্য এক কাহিনী। কলকাতার বুকে এক বাঙালি সিরিয়াল কিলারের কাহিনী। আর শুধু বাঙালি নয়, সে ছিল এক গৃহবধূ, মহিলা আঁততায়ী। একটু অবাক তো হচ্ছেন নিশ্চয়ই! কিন্তু এই অবিশ্বাস্য সত্যটির কারণ কী? এক গৃহবধূ থেকে সিরিয়াল কিলার হওয়ার গল্প কি সাধারণ? চলুন তবে এক নিরীহ ঘরোয়া নারীর নৃশংস হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।
বর্ধমানের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। বাবা ভাগচাষী। মেয়েটির নাম ত্রৈলোক্যতারিণী। তৎকালীন বাল্যবিবাহের শিকার ছিল মেয়েটি। সতীনের ঘরে কি আর স্বামী-সন্তানের সুখ জোটে? তাই বিয়ের পরও জায়গা হয় বাপের ভিটেতেই। কিন্তু সমস্যা হল যৌবনের জোয়ার যখন গায়ে লাগল। গ্রামের এক যুবকের প্রেমে পড়ল মেয়েটি। রাতের অন্ধকারে যুবকের হাত ধরে বেরিয়েও পড়ে সে। কলকাতার সোনাগাছিতে ভাড়ায় সংসার শুরু হয় দুজনের। হঠাৎই তারিণী ওই যুবকের সঙ্গ থেকে মুক্ত হতে চায়। নিজের মতো জীবনযাপনের স্বাদ পেতে চায় সে।
শুরু করল পতিতাবৃত্তির পেশা। আর পরিচয় ঘটল অপরাধ জগতের উঁচু মাথাগুলোর সাথে। এমনকি তাদের সাহায্যেও এগিয়ে যেত বারংবার তারিণী। আর ঠিক তেমন সময়েই মৃত্যু হল সেই প্রেমিক যুবকটির। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের তীর যায় তারিণীর দিকেই। সে আটক হয়। কিন্তু প্রমানের অভাবে ছাড়াও পেয়ে যায়। আর তারপরই শুরু হয় তার নৃশংসতার জীবন। বাড়তে থাকল খুনের তালিকা। বহু পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কেও লিপ্ত হয় তারিণী। আর সেইসব পুরুষ সঙ্গীর দ্বারাই পৌঁছে যেত ধনী বাড়ির মেয়েদের কাছে। হিংস্রতার সঙ্গেই শিকার চলত তাদের।
পুলিশের পাশাপাশি সেই সময়ের একজন স্বনামধন্য লেখক হিসেবে পরিচিতি ছিল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের। তার প্রকাশিত বই ‘দারোগার দপ্তর’ থেকেই বিস্তারিত জানা যায় বাংলার প্রথম এই সিরিয়াল কিলারটি সম্পর্কে। মাত্র কিছুদিনের ফারাকেই নাকি উধাও হয়ে যান কলকাতার পাঁচ মহিলা। ঘটনাসূত্রে জানা যায়, সবার আর্থিক অবস্থা ছিল বেশ উন্নত। এমনকি সবার মৃত্যুও হয়েছে জলে ডুবে। পরে তদন্তে জানা যায়, এই মহিলাদের নাকি নানা ছলনায় ডেকেছিল তারিণী। তার ঘাঁটি ছিল মানিকতলার পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি। ওই মহিলাদের গয়না লুট করে ডুবিয়ে খুন করত ত্রৈলোক্য তারিণী।
ধরা পড়লেও প্রথমে সে তার অপরাধ স্বীকার করেনি। কিন্তু প্রিয়নাথবাবুর বিশেষ পুলিশি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে এই তারিণী। তার পালিত এক পুত্র হরির উপর খুনের দায় চাপিয়ে দেন দারোগাবাবু। আর তাতেই নিজের অপরাধের প্রমান, নিজেই বের করে আনে তারিণী। জেরায় সে জানায়, পেটের দায়েই তার এমন নৃশংসতার সৃষ্টি। দোষ প্রমান হলে ফাঁসিও হয়। দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বাবু ও বারবণিতা’ বইটিতেও বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে তারিণীর নাম।
বাল্যবিবাহ, শ্বশুরবাড়ির বঞ্চনা, নিজের সমস্ত সুখকে চোখের সামনে তিলে তিলে নষ্ট হতে দেখেছিল এই নারী। হয়ত ভালোবাসার ভাষাটাই সে কোনোদিন বুঝে ওঠার সুযোগ পায়নি। তাই নিজের শরীর বেচতেও তার কুন্ঠা বোধ হয়নি। সমাজের কলুষতাকে, অবহেলাকে ছোট থেকে অনিচ্ছায় গিলেছে সে। তাই খুনের আগে হাত কাঁপত না তার। আর সহজেই হয়ে ওঠে বাংলার নৃশংস প্রথম সিরিয়াল কিলার।
Discussion about this post