চার্লস জোহান আর্ল ক্যানিং। নামটা খুব অপরিচিত নিশ্চয়ই নয়৷ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতের একসময়ের গভর্নর-জেনারেল এবং ভাইসরয় ছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন লর্ড উপাধিও৷ এমনকি তার নামে পশ্চিমবঙ্গে একটি জায়গাও রয়েছে, ‘ক্যানিং’। মাতলা নদীর ধারে অবস্থিত এই জায়গাটিকে ‘সুন্দরবনের প্রবেশপথ’ও বলা হয়ে থাকে। এই ক্যানিংয়েই বিশেষ একটি বাড়ির সঙ্গে জড়িত রয়েছে লর্ড ক্যানিংয়ের নাম। লর্ড নাকি সেখানে বসবাসও করেছেন। বেশি দূর নয়, ক্যানিং স্টেশন থেকে মাত্র মিনিট খানেকের পথ। স্টেশনের বাইরের পাকা রাস্তা বেয়ে এক চার মাথার মোড়, তারই বামে অবস্থিত সেই বাড়ি। বর্তমানে যা লর্ড ক্যানিংয়ের বাড়ি হিসাবেই বিশেষ পরিচিত।
রাজ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ক্যানিংই ছিল প্রথম পুরশহর। লর্ড ক্যানিংয়ের সহায়তায় সেইসময় গড়ে উঠেছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি। তারই সুবিধার্থে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হিসাবে ক্যানিংয়ে রেলপথ স্থাপিত হয়৷ ক্যানিংয়ে লর্ড প্রশাসনিক কাজকর্ম করার উদ্দ্যেশ্যে একটি বিশেষ বাড়ি বানান। যা ছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির সদর দপ্তর। সেইসময় যা প্রশাসনিক ভবন হিসাবেই বেশি পরিচিত ছিল। এমনকি লেডি ক্যানিং যখন আসতেন তখন এই বাড়িতেই কিছুদিন কাটিয়েও যেতেন। তবে আনুমানিক ১৮৭২ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় এই কোম্পানি। পূর্বে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের নামে ক্যানিং বন্দর থেকে কৃতদাস রপ্তানি হত ইংরেজ উপনিবেশ গুলিতে। এর ফলে টাকা আমদানি হত প্রচুর, যা বন্দরের কাজকর্ম চালানোর কাজে আসত। জাহাজে করে কৃতদাস পাঠানোর সময় একবার ডুবে যায় সেই জাহাজ। তারপরই সরকার এই ক্যানিং বন্দর থেকে কৃতদাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে পোর্ট বন্দরের টাকা আমদানিও তখন বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও স্থানীয় মাঝি এবং শ্রমিকদের অসহযোগিতাতেও বন্ধ হয়ে যায় এই বন্দর। তার সঙ্গে বন্ধ হয় কোম্পানির সদর দপ্তরটিও। নামমাত্র টাকার বিনিময়ে কোম্পানির স্থানীয় কারুর কাছেই তখন বিক্রি হয়ে যায় বাড়িটি।
বর্তমানে সেই বাড়ির এখন ভঙ্গুর দশা। লোহার মূল দরজাটি এখন আর নেই। ভিতরের দেওয়ালেরও জীর্ণ অবস্থা৷ থেকে থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা। বাড়িটিতে মোট ১১টি ঘরের মধ্যে এখন মাত্র দুটি ঘরই ব্যবহারযোগ্য। বর্তমানে বাড়িটিতে বহু আগেকার কেয়ারটেকারের পরিবারই বসবাস করেন। বাড়িটির ভূগর্ভস্থ এক প্রবেশ পথ ছিল। ব্যবহারের অভাবে এখন বন্ধ সেই পথও। ইংরেজ আমলের বহু জিনিসপত্র ছিল এই বাড়িতে। তবে তা আজ আর আগের অবস্থায় নেই। বেশিরভাগই হয় নষ্ট অথবা বিক্রি হয়ে গিয়েছে৷ সম্প্রতি আমফানে এই ভঙ্গুর বাড়িটি আরও ভেঙে পড়েছে৷ প্রশাসনের তেমন কোনও নজরও যেন নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এই বাড়ি এখন আবার যেন ইতিহাসেই মিশে যেতে চলেছে। ক্যানিংয়ের বানানো এবং তাঁর নাম জড়িত এই বাড়ির ভবিষ্যৎ যে ঠিক কী তা এখন কেই বা বলতে পারে!
চিত্র ঋণ – অলকেশ মৈত্র এবং সম্বুদ্ধ মুখোপাধ্যায়
Discussion about this post