বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো শুধুমাত্র পুজো নয় বরং তা এক আবেগ। মফস্বল হোক বা শহর পুজোর রোশনাইতে সেজে ওঠে প্রতিটি জায়গা। এখন জায়গায় জায়গায় থিম পুজোর রমরমা হয়ে গেলেও কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোগুলোর এখনো এক আলাদাই মর্যাদা রয়েছে। কলকাতার বনেদি পুজোর কথাই যদি বলতে হয় সেক্ষেত্রে রাণী রাসমণির বাড়ির পুজোর কথা কিন্তু না বললেই নয়। দুই শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন এই পুজো। সুতরাং বোঝাই যায় এই পুজো শুধু পুজো নয় বরং এক ইতিহাস।
জানবাজারের রাণী রাসমণির বাড়িতে দুর্গা পুজোর প্রথম আয়োজন শুরু করেন ১৭৯০ সালে তার শ্বশুরমশাই পীতম্বর দাস মহাশয়। এই বাড়ির দেবী পূজিত হন একচালা শোলার সাজে। তবে এই পুজোর এক অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হল পুজোয় দেবী মূর্তি কোনো ছাঁচে তৈরি করেন না শিল্পী। বরং তা সম্পূর্ণ তৈরি হয় শিল্পীর নিজ দক্ষতায়। বাড়ির সামনের বারান্দার নাটমন্দিরেই আয়োজন করা হয় দেবীর পুজোর। শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর পুজোর দায়িত্ব নেন রাসমণির স্বামী। এরপর তার মৃত্যু হলে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন তিনি। বলা বাহুল্য তখন থেকেই এই পুজোর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। এই পুজোয় সাক্ষী ছিলেন রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র সকলেই। ১৮৬৪ সালে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংহদেবও উপস্থিত ছিলেন পুজোয়। এরপর ১৮৪৫-৪৬ সালে রাসমণির বাড়িতেই প্রথম বিধবা বিবাহ প্রচলন করেছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘দেবী’তে ব্যবহৃত দুর্গা প্রতিমার মুখের আদল ছিল রাসমণির বাড়ির দুর্গা প্রতিমার আদলেই।
রাণী রাসমণি দেবীর বাড়ির পুজো আজও প্রাচীন ঐতিহ্য সুন্দরভাবে বহন করে চলেছে। এই পুজো মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত। তবে এতগুলো বছর পরেও এই পুজোর আভিজাত্য ও সাবেকিয়ানায় এতটুকু ঘাটতি পড়ে নি। পুজোয় ষষ্ঠীর দিন হয় বেলবরণ এবং বোধন। দেবীকে সাজানো শুরু হয় সেই দিন থেকেই। গয়না দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয় দেবীর অঙ্গ এবং হাতে সাজানো হয় অস্ত্র। এরপর সপ্তমীতে ঠাকুর দালানে নিয়ে আসা হয় বাড়ির আরাধ্য দেব দেবীদের। অষ্টমী নবমী জুড়ে চলে দেবীর অঞ্জলি, পুজো। তবে সপ্তমী থেকে নবমী তিনদিন ধরেই চলে কুমারী পুজো। রাণীর সময়কাল থেকেই তাদের অন্দরমহল থেকে ঠাকুর দালান অবধি করা ছিল এক বিশেষ সিড়ির ব্যবস্থা। পুজোর চারদিন সেই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করেন বাড়ির মেয়ে বউরা। দেবীর ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় লুচির সাথে পাঁচ রকম ভাজা তবে সব রান্নাই নুন ছাড়া। রাণীর সপ্তম বংশধর প্রসূন হাজরা বলেন যে তারা চেষ্টা করে চলেছেন পুজোর সাবেকিয়ানা ও ঐতিহ্য ধরে রাখার। রাজ্যের পর্যটন দফতর দ্বারা আয়োজিত পরিচালিত সফরের অন্যতম স্থান হল এই পুজো। এছাড়াও এই পুজোয় দর্শনার্থীদের সামিল করা হয় বিকেল থেকেই এবং সকলকেই ভোগ বিতরণ করা হয়।
Discussion about this post