গত বছর থেকেই মহামারী পরিস্থিতিতে বিপন্ন মানুষের জীবন। কিন্তু কথাতেই আছে – বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্ব্বন! তাই শত কষ্টের মাঝেও বিধিনিষেধ মেনেই সে বারবার মেতে উঠেছে উৎসবে, খুঁজে নিয়েছে একরাশ আনন্দ। দেখতে দেখতে এ বছরও আসন্ন মায়ের আগমন। শুরু হয়ে গেছে খুঁটিপুজো, কুমোরটুলিতে সাজো সাজো রব। মহালয়ার সকালে কুমোরটুলিতে দেবীপ্রতিমার চক্ষুদানের মাধ্যমেই ঘটে দেবীপক্ষের সূচনা। বহু বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই কুমোরটুলি। তাছাড়া এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প কেন্দ্রও বটে! তাহলে ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই আজ বরং জেনে নিই, কীভাবে এই কুমোরটুলি হয়ে উঠল মায়ের আরাধনার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ!
কুমোরটুলির ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে। কলকাতা শহরের উত্তরে শোভাবাজার সুতানুটিতে অবস্থিত এই কুমোরটুলি। অবিভক্ত বাংলায় ১৬০৬ সালে দুর্গা পুজোর প্রচলন ঘটিয়েছিলেন নদীয়া জেলার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। পরবর্তীতে পলাশির যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ব্রিটিশরা বিভিন্ন পেশার মানুষের কাজকর্মের জন্য বিভিন্ন জায়গা নির্ধারণ করেন। যেমন, সুরা বিক্রেতাদের জন্য শুঁড়িপাড়া, কাঠের মিস্ত্রিদের জন্য ছুতারপাড়া, কুমোরদের জন্য কুমোরটুলি ইত্যাদি। এই সময়ই নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি অঞ্চল থেকে থেকে কুমোররা ভালো আয়ের আশায় কলকাতা শহরে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণদেব কলকাতায় দূর্গাপূজা শুরু করেন। তখনকার দিনে কুমোরদের সিংহ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। তাই রাজা নবকৃষ্ণদেবের বাড়ির প্রতিমায় সিংহের বদলে ঘোড়ার মূর্তি ব্যবহার করা হয়। তারপর কেটে গেছে প্রায় তিন শতক, কিন্তু এই রীতি আজও অব্যাহত!
কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা আজ সর্বজনবিদিত। রথযাত্রার দিন গণেশ এবং লক্ষ্মীর আরাধনা করেই দূর্গাপ্রতিমা তৈরীর কাজ শুরু হয়। প্রথমে কাঠ দিয়ে মূল কাঠামোটি তৈরি করা হয়। তার ওপর বাঁশের ফ্রেম, খড় ও সুতলি দিয়ে প্রতিমার আকার দেওয়া হয়। প্রতিমা বানাতে প্রধানত দু’রকম মাটি ব্যবহার করা হয় – এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। এঁটেল মাটি দিয়ে প্রথমে মূর্তি গড়া হয় এবং পরে বেলে মাটি দিয়ে সেই মূর্তিগুলিকে পালিশ করা হয়। গঙ্গা থেকেই প্রধানত মাটি আনা হয়, যদিও উলুবেড়িয়া থেকে আনা মাটিই বেশী পছন্দ করেন শিল্পীরা। ১৯৩৩ সালে শুরু হয় কুমোরটুলির নিজস্ব সার্বজনীন দুর্গোৎসব। আগে প্রতিমা একচালা ডিজাইনেই তৈরি করা হত। কিন্তু ১৯৩৭-৩৮ সাল নাগাদ কুমোরটুলির বারোয়ারি পুজোয় ঘটে যায় এক অগ্নিকাণ্ড। এরপরই কুমোরটুলিতে দোচালা ডিজাইনের প্রতিমার প্রচলন ঘটান শিল্পী গোপেশ্বর পাল।
কুমোরটুলির শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেন মোহনবাঁশী রুদ্রপাল, তাঁর দুই পুত্র সনাতন ও প্রদীপ, গোরাচাঁদ পাল, রাখাল পাল প্রমুখ। প্রথমে কেবল পুরুষরাই প্রতিমা তৈরি করতেন কুমোরটুলিতে। কিন্তু ১৯৯০ থেকে দুই শিল্পী মালা পাল ও চায়না পাল শুরু করেন প্রতিমা গড়া। পরে আরও যোগ দিয়েছেন মিনতি পাল, সোমা পালসহ প্রায় ৩০ জন মহিলা। মালা পাল পরবর্তীকালে নিউ দিল্লির ন্যাশনাল হ্যান্ডিক্রাফ্টস অ্যান্ড হ্যান্ডলুম মিউজিয়াম থেকে এক্সিবিশনের জন্য ডাক পান। তাঁর গড়া প্রতিমা রপ্তানি হয় সুদূর জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্রই। প্রায় ১২০০০ প্রতিমা প্রতিবছর তৈরি হয় এখানে। কমপক্ষে ৯০টি দেশ থেকে এখানে প্রতিমার বায়না আসে। এমনকি ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে অনলাইনে প্রতিমা বিক্রয়ও! কাজেই, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অবশ্যই একবার ঘুরে আসবেন এই কুমোরটুলি থেকে। এমন অসাধারণ শিল্পের মুগ্ধতা একটিবার সামনাসামনি উপভোগ না করলে কি চলে!
প্রচ্ছদ চিত্র সৌগত সিনহা
Discussion about this post