বাঙালি আজকের ২০২১ এ সারা পৃথিবীতে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও কলকাতার প্রতি সে আজও এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। কলকাতার প্রেমে সে বার বার হাবু ডুবু খায়। কলকাতার উৎপত্তিটাই নানা সময়ের কাল চক্রে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা খুঁজে পাই। এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েও কলকাতা নগরীটার কোণে কোণে পাওয়া যায় অজানা নানা তথ্য। জব চার্নকের আগের কলকাতার কথাই ধরা যাক। দ্বাদশ শতাব্দীর আগে পোদ্ , জেলে, দুলে বাগদী এই আদিবাসী দের নিয়ে একটা জনবসতি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল কালী ক্ষেত্র। বর্তমানের বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বরের মধ্যবর্তী জায়গাই কালীক্ষেত্র নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মার্টিন সাহেব দক্ষিণেশ্বরকে সেই সময়ে বাংলার রাজধানী হওয়ার উপযুক্ত মনে করতেন।
আরও পিছনের দিকে ইতিহাসের পাতা থেকে জানা কিছু তথ্য। গুপ্ত আর হর্ষবর্ধনের সামাজ্যের পতনের পর তাঁর বংশের মানুষজন তাদের সঞ্চিত ধনরত্ন আর কুলদেবী সিংহবাহিনীকে নিয়ে বাংলার করখানি গ্রামে বসবাস শুরু করে। পরে সেই জায়গাই সপ্তগ্রামে প্রসিদ্ধ হয়। পুরনো জমিদারদের বাড়িকে কেন্দ্র করেই হাট বাজার এবং পরে হাট খোলা গড়ে উঠেছিল। কলকাতার প্রাথমিক উন্নতির অবদানে যোগ্য কান্ডারি ছিলেন কালীঘাটের পুরোহিত ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী, তাঁর আত্মীয় রাম গোবিন্দ রামশরণ,যাদবেন্দ্র সহ আরও অনেকে। গোবিন্দপুরের জন্ম মোটামুটি ১৫২০ থেকে ১৫৩০ এর মধ্যে। কারণ সেই সময়ের কালীঘাটের হালদার বংশের ভবানীপ্রসাদ চক্রবর্তী এবং তার দুই ছেলে গোবিন্দপুরে থাকতেন। এছাড়া নানা জায়গা থেকে সম্ভ্রান্ত কায়স্থ, বৈদ্য নবশাখেরা গোবিন্দপুরে বসতি গড়ে তোলেন। রাজা প্রতাপদিত্যের দেওয়া জমিদারী ভোগ করতেন টাকীর জমিদার রায় চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ আর খুলনা বাগের সম্ভ্রান্ত জমিদার বর্গ। অনুমান করা হয় তাঁরাই কেউ গোবিন্দপুরের নামকরণ করেছিলেন।
কত শত গল্পের আড়ালে লুকিয়ে আছে আমাদের কলকাতা। কলকাতার নানা পথ চলতে চলতে আর নথিপত্র ঘাঁটার পরও মনে হতে পারে হয়ত আরও কত অজানা তথ্য হয়ত অধরাই রয়ে গেছে কলকাতার বুকে। গোবিন্দ রাম শরণের নাতি রামচন্দ্র দত্ত বানিয়ে ছিলেন হাট খোলা বাজার। তাঁর বাড়ি ছিল ছড়ানো নিমতলা পর্যন্ত। শোনা যায় ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গার বুকে পর্তুগীজদের প্রথম জাহাজ এসে গোবিন্দপুরের শেঠ বসাকদের সঙ্গে জামা কাপড় কেনাকাটা করেছিল। কলকাতার আদি বসবাস কারী হিসাবে শেঠ আর বসাকদের সম্মান দেওয়া হয়। শোনা যায় কালিদাস বসাক ছাড়াও বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার , ব্যবসায়ী মানুষ জন সেখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। সময়টা ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দ ছিল।
মোঘল সাম্রাজ্যের সময়ে বাংলা থেকে শুরু করে সারা ভারতবর্ষের বুকে একটা অন্ধকার সময় ঘনিয়ে আসে। নারীর স্বাধীনতা আর শিক্ষা ব্যবস্থা দুই-ই বিলুপ্ত হয়। কারণ মোঘল সম্রাটের দরবার পর্তুগীজরা সুন্দরী রমণী পাচার করেই যে সম্মান অর্জন করত তাকে গৌরবের মনে করত। জানা যায় মোগল সাম্রাজ্যের সময় থেকে পর্তুগীজরা সুতো আর নটীর ব্যবসা করত। সেই থেকে ঐ স্থানের নাম হয় সুতানটী। ভগবতী কালির নাম থেকেই কলকাতা নামের সৃষ্টি হয়েছে। সেটা অনেক ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন। অনেকেই আবার মনে করেন ওই কালীক্ষেত্রই পরে কলকাতা হয়। সম্রাট অশোকের সময় ১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দে টোডরমল্লের রাজস্ব তালিকায় বা ১৪৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগরের ভ্রমণ তালিকাতেও কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। আসলে কয়েশো বছর আগে বাংলাদেশের আর কোথায় কী আড়ত বা বসতি ছিল সেটা অনুসন্ধান সাপেক্ষিক। তবে শুধু গোবিন্দপুর, সুতানটী আর কলকাতাই বাসযোগ্য এলাকা ছিল না। এটা হলফ করে বলাই যায়।
Discussion about this post