সালটা ১৮৫৪। সকাল ৮টা নাগাদ হাওড়া থেকে হুগলির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে একটি ট্রেন। ৯১ মিনিটের এই যাত্রাপথই এক অনন্য ইতিহাস লিখে দেয়। শুরু হয় হাওড়া স্টেশনের পথ চলা। তবে আজ যে জৌলুসপূর্ণ বিশাল লাল বাড়িটাকে দেখি, সেটাই কিন্তু শুরু থেকে ছিল না। নানা বিবর্তন, নানা পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে রূপ পায় ভারতের সবচেয়ে বড়ো স্টেশনটি। হয়ে ওঠে রেলযাত্রীদের অন্যতম এক প্রাণকেন্দ্র।

আজ যেখানে বিশাল হাওড়া স্টেশন দাঁড়িয়ে, সেখানে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছিল একটি অনাথ আশ্রম। মূলতঃ রোমান ক্যাথলিক ছেলেমেয়েদের জন্য। এর পাশে ছিল পর্তুগিজ মিশনারিদেরই একটি গির্জা। সব ঠিক চললেও বাঁধ সাধল এক ভয়ঙ্কর মহামারী। তাই সেখানকার সমস্ত বাচ্চা, কর্মী, মিশনারিদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতার দিকে। পর্তুগিজরা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানিকে বিক্রি করে দেয় এই জায়গাটি। তার আগে থেকেই হাওড়ায় একটা স্টেশন বানানোর পরিকল্পনা করছিল কোম্পানিটি। পর্তুগিজদের জমিটি সেই সম্ভাবনাকে এগিয়ে দিল খানিকটা। শুরু হয় স্টেশন তৈরির কাজ। তবে প্রথমদিকের স্টেশন বলতে বিরাট কিছু ছিল না। তখন হাওড়াকে জংশন স্টেশন হিসেবেও ভাবা হয়নি। একটি মাত্র প্ল্যাটফর্ম; আর সঙ্গে ছিল লাল ইটের একতলা বাড়ি। সেটিই ছিল আদি হাওড়া স্টেশন। ভেতরে ছোটো জানলা একটি দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হত। এছাড়াও ছিল একটি স্টোর রুম। ব্যস, এই হল প্রথম হাওড়া স্টেশনের রূপ। এই চেহারা যে আজ আর নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু রয়ে গিয়েছে প্রথম লাইনটি। জানেন কি! হাওড়া স্টেশনের ১৭ নম্বর লাইনটিই হল সেই লাইন।

১৯০১ সাল নাগাদ শুরু হয় বর্তমান হাওড়া স্টেশনের লাল বাড়িটির কাজ। যা শেষ হয় ১৯০৬ সালে। কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশন যেতে প্রায় সবাই এখন ব্যবহার করে হাওড়া সেতু। কিন্তু তার আগে? হ্যাঁ, গঙ্গাই ছিল একমাত্র ভরসা। আর্মেনিয়ান ঘাটে তৈরি করা হয় রেলের টিকিট কাউন্টার। সেখান থেকেই টিকিট কেটে রেল কোম্পানির লঞ্চে করে ওপারে যাওয়া হত। উল্লেখ্য, এই ক্ষেত্রে লঞ্চের ভাড়া রেলের ভাড়ার সঙ্গেই জুড়ে থাকত।
১৮৫৪ সালের ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল বহু মানুষ। তিন হাজার দরখাস্তের মধ্যে থেকে মাত্র কয়েকশোই সুযোগ পান প্রথম যাত্রায় সামিল হওয়ার। প্রথম ট্রেন দর্শনের জন্য ছোট্ট হাওড়া স্টেশনে সেদিন উপচে পড়েছিল অগণিত মানুষের ভিড়। তখনও কাশবনের ভেতর দাঁড়িয়ে অপু’র প্রথম ট্রেন দেখার কথা কেউ জানত না। কিন্তু তাদের চোখেও হয়ত সেই হারিয়ে যাওয়ার নেশা ফুটে উঠেছিল। এরকমই হাজার স্বপ্নের ভেতর দিয়ে ট্রেন ছুটে ছিল। আজ প্রায় ১১৮ বছর ধরে হাওড়া স্টেশন দাঁড়িয়ে বহু মানুষের অপেক্ষার সঙ্গী হয়ে।
Discussion about this post