সামনেই বড়দিন। কেক উৎসব। ব্রিটিশ আধিপত্য থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে যেন বিদেশি রীতির সংমিশ্রণ ঘটে এসেছে। তাই আজ ব্যক্তিগত জন্মদিনে বাঙালির পায়েস মিষ্টিকে ছাপিয়েছে বার্থ ডে কেক। আর শুধুই জন্মদিন বলি কেন, বিবাহবার্ষিকী হোক বা যে কোনও খুশির উদযাপন। একটা কেক এলে, ব্যপারটাই কেমন যেন গ্ল্যামারাস হয়ে ওঠে। আজ বাংলার দিকে দিকে কেক-পেস্ট্রি-বেকারির সম্ভার। কিন্তু জানতে ইচ্ছে কি করে, কিভাবে বাংলায় কেক-পেস্ট্রির ব্যবসাটা দাঁড়ালো? নিশ্চয়ই করে। তবে চলুন বাংলায় কেকের আবির্ভাবের ইতিহাসটা কেমন একটু দেখি।
কেক পেস্ট্রি প্যাটিসের আদিবাড়ি বলতে ধর্মতলা চত্বর। হগ মার্কেট বললে আরও ভালো হয়। ১৮৩০ সালে ডেভিড উইলসন নামের এক সাহেব বাংলায় প্রথম কেক তৈরি করেন। একটি হোটেলের উদ্বোধনের জন্য এটি বানিয়েছিলেন। সেই হোটেল আজও অক্ষত। ‘দ্যা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’ নামেই কোলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজও সেই পুরোনো স্বাদ পাওয়া যায় এখানের কেকে। কিছুটা ভোল বদল হয়েছে বটে, কিন্তু স্বাদের বিশেষত্বটা আজও আছে এখানে।
এরপর ১৯০২ সাল। সুদূর বগদাদ থেকে নাহুম ইজরায়েল নামের এক ইহুদী কলকাতার হগ মার্কেটে প্রথম কেকের দোকান শুরু করেন। খুব তাড়াতাড়িই তার দোকান জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে। সাহেবদের বিশেষ পছন্দের ছিল সেই দোকানটি। এখনো নাহুমের কেকের বাজারি চাহিদাই অন্য মাত্রায়। মানুষের ভিড় সারাবছর চোখে পড়ে সেখানে।
প্রায় ৯০ বছর আগে। বড়ুয়ারা প্রথম টিফিন কেক বানানো শুরু করে। প্রথম বাঙালি বেকারি ছিল এটি। ময়দানের ক্লাবগুলোতে এই বেকারি কেকের চাহিদা ছিল তীব্র। মধ্যবিত্তদের জন্য এই কেক সুলভে পাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু আজ বড়ুয়া বেকারির অস্তিত্ব প্রায় হারিয়েছে। অর্ডারের কেক ও সিগনেচার কেক ছাড়া আর কিছুই নেই। থাকার মধ্যে শুধুই, স্মৃতির চাদর মুড়ে সিআইটি রোডের ধারে ঘুপচিতে বেঁচে রয়েছে বড়ুয়া বেকারিটি।
শ্রমিক অসন্তোষ, কেক প্রস্তুতির ত্রুটি এবং মোড়কের চাকচিক্যে সেভাবে আর কোনো বাংলার কোম্পানি বাজার জমাতে পারেনি। বদলে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে বিদেশী কোম্পানির কেক। ব্রিটানিয়া, মিও আমোর, ক্যাথলীনের পেস্ট্রি প্যাটিসই আজ এই পুরো বাংলার বাজার দখল করেছে। ৫০ এর দশকে ‘মনজিনিস’ ইতালির কোম্পানি ‘সুইটজ’ এর সাথে যৌথ ব্যবসা করে মুম্বাইতে। পরে মালিকানা নিয়ে বিবাদে, কলকাতা ‘মনজিনিস’ পরিণত হয় মিও আমোরে। ‘উইনকিস’এর প্রসারও রয়েছে বিস্তর পূর্ব ভারতে। ১৯৭৮ সালে ক্যাথলীন তার ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু অতিরিক্ত দাম হওয়ায় সংকটের মুখে এর ভবিষ্যৎ। ২০০৫ এ আসে ‘জাস্ট বেক’ কোম্পানি আসে বাংলায়। দক্ষিণ ভারতের ব্র্যান্ড এটি।
কেকের প্রতিযোগিতায় এই কেকটি এখনও তার মঞ্চ ছাড়েনি। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং অতি নিম্নবিত্ত বাড়িতে তার চাহিদা সবথেকে বেশি। সবথেকে বড় ব্যপার হল, তার মোড়কের জৌলুস বলে কিছু নেই। কিন্তু তাও বাঙালির আবেগে জড়িয়ে রয়েছে আজও ‘বাপুজি কেক’। ১৯৬৯সালে শীতল চন্দ্র লাহা এই বেকারিটি চালু করেন। বোন অপর্ণা জানা সাহায্য করেন। ‘দ্যা নিউ হাওড়া বেকারি’ আজও ‘বাপুজি কেক’ হিসেবে বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকছে। পথচলতি খেটে খাওয়া মানুষের হাতে, স্কুলের টিফিন বক্সে একমাত্র বাপুজি কেকের চাহিদাই বহুবছর উচ্চ মাত্রায়। দৈনিক ৫০ হাজার টিফিন কেক তৈরী করেন তাঁরা।
বাংলায় কেকের বাজার বা কেকের কারখানা অনেকখানি এগিয়ে। কেক আজ বহু মহিলাকে স্বনির্ভরও করে তুলেছে। বাড়িতে কেক বানিয়ে অনলাইনে বিক্রিতে তৎপর হয়েছে তারা। তাই আজ আর শুধু কেক খাওয়া নয়। কেক শিল্পে বাংলার অনেক মানুষই নাম লিখিয়েছেন।
Discussion about this post