এই মুহুর্তে ভারতে সমস্ত পাহাড়, নদী, উপত্যকা, গাছপালা সামগ্রিক পরিবেশ নিয়েই পরিবেশকর্মীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও কম চিন্তিত নন। শুধু ভারত কেন, সারা বিশ্বেই পরিবর্তন হচ্ছে পরিবেশে, বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্রের কাঠামো, বিশ্ব উষ্ণায়ন আর শুধু টেক্সট বুকের পরিভাষ্য নয়, বরং ভীষণ বাস্তব, গলে যাচ্ছে সুবিশাল হিমবাহগুলি, বেড়ে চলেছে সমুদ্র স্তর। অথচ, মানুষ কিন্তু গাছ কেটে চলেছে, পুকুর বুজিয়ে তৈরি করে চলেছে বহুতল, খনন হচ্ছে কয়লা খনি। এককথায় পৃথিবী ভরে উঠছে ইট-কাঠ-পাথরে। ফলে সচেতন মানুষের মন শুধু ভারাক্রান্তই নয়, তার চেয়েও বেশি আতঙ্কিত।
বর্তমানে সারা ভারত জুড়ে চলছে আন্দোলন। প্রকৃতিরক্ষার জন্য লাদাখের সোনাম ওয়াংচুক আমরণ অনশনে। এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে শোনা যায়নি একটিও বাক্য। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ১১ বছর আগে। তবে তখন অনশনরত মানুষটিকে শেষে মরে যেতে হয়েছিল। তাঁর নাম প্রফেসর জি ডি আগরওয়াল, ওরফে স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ। তিনি ভারতের পরিবেশবিদ্যার পথ প্রদর্শক। একাধারে শিক্ষক, গবেষক ও আধ্যাত্মিকচেতনা মিশ্রিত তাঁর ব্যক্তিত্ব। আই আই টি রুরকি ও বার্কলে থেকে পড়াশোনা ও গবেষণা শেষ করে আই আই টি কানপুরের প্রফেসর হন। ১৯৭৯ সালে ইন্দিরা গান্ধি তাঁকে সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম মেম্বার সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বুন্দেলখণ্ডের চিত্রকুটে মহাত্মাগান্ধী গ্রামোদয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। থাকতেন একটি ছোট ঘরে, পরতেন হাতে বোনা খদ্দর, রান্না করতেন নিজে, বাহন ছিল সাইকেল। গঙ্গার ‘অবিরলতা ও নির্মলতা’ ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।
২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত স্বামী সানন্দ গঙ্গার উৎসমুখ থেকে ভাগীরথী এবং অন্যান্য জলধারাগুলির উপর বাঁধ নির্মাণ, গঙ্গা বক্ষে বালি ও পাথরের খাদান তৈরি ও গঙ্গার রিজুভিনেশন এর নামে সরকারি অর্থ অপচয়ের বিরুদ্ধে মোট পাঁচবার অনশন করেন। ইউপিএ সরকারের সময় তাঁর অনশনের জোরে গৃহীত হয়েছিল বিভিন্ন কর্মসূচী। কিন্তু গঙ্গাকে সম্পূর্ণ উদ্ধার করা যায়নি। এরপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী বারাণসীর ঘাটে নিজেকে ‘গঙ্গাপুত্র’ বলে, ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প ঘোষণা করেন। স্বামী সানন্দের জীবন ও সংগ্রাম এগোয় এক নিষ্ঠুর সমাপতনের দিকে।
মাতৃসদন আশ্রম এবং তার পরিবেশরক্ষার ও আত্মবলিদানের ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সকলেই প্রায় একই সঙ্গে সন্ন্যাসী, পরিবেশ ও বিজ্ঞানকর্মী। স্বামী সানন্দ তাঁর শেষ অনশন শুরু করেছিলেন ২০১৩ সালে উত্তর কাশীতে, তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন মাতৃসদনের সন্ন্যাসীরা। স্বামী সানন্দ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দাবি করেছিলেন জলধারার ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করতে হবে, গঙ্গাবক্ষে বালি ও পাথর খাদান বন্ধ করতে হবে। কোনো জবাব দেননি পিএম। ১১২ দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। বিজ্ঞান মনস্কতার শেষ নিদর্শন হিসেবে তিনি মরণোত্তর দেহদানও করে যান। আর পিএম টুইট করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন মাত্র।
Discussion about this post