অনেক দিন আগের কথা, বিখ্যাত কবিয়াল রাম বসু আসর জমিয়েছেন। কবির লড়াই তখন চরমে ! ভাষায় একটা তাচ্ছিল্য নিয়ে তিনি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির উপর চাপান, “সাহেব ! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালিও তাের পাদরি সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চুন কালি।” মনের আনন্দে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সাহেব উত্তরে বলেন,”খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই। শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই। আমার খােদা যে, হিন্দুর হরি সে। ওই দেখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে,আমার মানব জনম সফল হবে যদি ঐ রাঙা চরণ পাই।” প্রায় দুশো বছর আগে অ্যান্টনি সাহেব যা বলেছিলেন তার বাস্তবোচিত উল্লেখ আমরা দেখতে পাই শ্রীরামপুরের এক চমৎকার নিদর্শনে। নাম তার ‘হেনরি মার্টিন প্যাগোডা’, স্থানীয় মানুষ জন একে ‘ভাঙা মন্দির’ বা ‘জলকল মন্দির’ বলেই চেনেন। প্রথম দিকে যা ছিল রাধাবল্লভের মন্দির। পরবর্তীকালে ভাগীরথীর ভাঙনে তা পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ঈশ্বরের আলয় বেশিদিন ফাঁকা থাকেনি, তাই ইষ্ট রূপে খৃষ্ট উপাসনার সূত্রপাত হয় এখানে। মন্দিরের কাঁসর ঘন্টা পাল্টে যায় চার্চের বেলে, হরি বোল পরিবর্তিত হয় প্রভু যীশুর নামে। তারপর? সমাজ কি মেনে নিয়েছিল?
ভাগীরথীর তীরে সম্ভবতঃ ১৬৭৭ সালে একটি আটচালা মন্দির নির্মাণ করে রাধাবল্লভ জীউর মন্দির স্থাপন করা হয়। ওই মন্দিরের নামে মাহেশ ও আখনা অঞ্চলের কিছু অংশ ভাগ করে একটি নতুন মৌজা গঠন করা হয় যার নাম হয় বল্লভপুর। এটিই ছিল রাধাবল্লভের প্রথম মন্দির। তবে কিছুকাল পরে নদীর ভাঙনে মন্দিরের ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেবায়েতরা শঙ্কিত হয়ে বিগ্রহকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করেন। ফলে মন্দিরটি অরক্ষিত অবস্থায় ক্রমশ জীর্ণ রূপ নেয়।
একটা ভাঙা পরিত্যক্ত মন্দিরে কোন সাহেব কীসের প্রার্থনা করলো তাতে সমকালীন সমাজের কিছু এসে যায়নি। সাহেবও তেমনি গোঁড়া, হিন্দুরা আগে ওই মন্দিরে পুজো করত বলে তিনি এটিকে বলেছিলেন ‘ডেভিল হাউস’। যাই হোক, তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় ভেদভেদের মধ্যেও দুই ইষ্টের এক উপাসনালয় হয়ে এই আলয়টি দেখিয়ে দিয়েছিল সত্যিই, “খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাই।” ভেদাভেদ ভুলে এক সুরে গাইলে সব ইষ্টই এক হয়ে যায়। ১৮০৩ সালে ওই পরিত্যক্ত মন্দিরসহ জমি ডেভিড ব্রাউন সাহেব কিনে নেন। তিন বছর পরে ১৮০৬ সালে হেনরি মার্টিন নামক এক পাদ্রী ইংল্যান্ড থেকে শ্রীরামপুরে আসেন। তিনি ব্রাউন সাহেবের কাছে আশ্রয় চাইলে ওই পরিত্যক্ত মন্দিরে থাকার জন্য ব্রাউন সাহেব অনুমতি দিয়েদেন। তারপর থেকেই হেনরি মার্টিন ওই পরিত্যক্ত মন্দিরে বসবাস ও খ্রিস্ট উপাসনা শুরু করেন। এর নাম হয় হেনরি মার্টিন প্যাগোডা। এই প্যাগোডা সম্পর্কে মার্টিন সাহেব লিখেছেন,”My habitation assigned to me by Mr. Brown is a Pagoda in his grounds, on the edge of the river. Thither I retired at night and really felt something like superstitious dread, at being in a place once inhabited as it were by devils.”
তবে মার্টিন সাহেব বেশিদিন সেখানে থাকতে পারেননি। ১৮০৯ সালে হেনরি মার্টিন শ্রীরামপুর ত্যাগ করলে ওই আলয় আবার পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৮৪৫ সালে ওই প্যাগোডাকে একটি ভাটিখানা বানিয়ে ফেলা হয়। শেষপর্যন্ত ১৮৯৩ সালে ওই জমি হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কস কিনে নিলে প্যাগোডাটি রক্ষা পায়। ১৯০৯ সালে ওই প্যাগোডাকে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের আওতায় আনা হয়। তবে দীর্ঘ দিন ধরে এই আলয়টি ভাঙাচোরা জীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকে। সম্প্রতি শ্রীরামপুর পৌরসভার তরফে এটিকে সংস্কার করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য একবিংশ শতাব্দীর মানুষদের হাত থেকেও এই প্যাগোডাটি রক্ষা পায়নি। প্যাগোডার সাদা দেওয়াল যেনো ফাঁকা উন্মুক্ত ক্যানভাস! আর তাতে অশালীন ভাষার সাহিত্য লিখে মানবজাতিকে উদ্ধার করেছে কিছু বিশিষ্ট মানুষজন। বাইরে কুৎসিত লাগলেও, নবসংস্কারের ফলে প্রায় সাড়ে তিন শতাব্দী প্রাচীন এই আলয় তার হারানো গুরুত্ব কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে।
Discussion about this post