রবিঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল আর দইওয়ালার প্রথম কথোপকথনটা ছিল এমন
“দইওয়ালা: দই , দই , ভালো দই!
অমল: দইওয়ালা, দইওয়ালা ও দইওয়ালা!
দইওয়ালা: ডাকছ কেন? দই কিনবে?”
মনে আছে? হ্যাঁ ফেরিওয়ালা। যারা মাথায় , কাঁধে কখনও বা ভ্যান রিক্সায় নানা পসরা সাজিয়ে কলকাতার বুকে অলি গলিতে ঘুরে বেড়াত। এখনও দেখা যায়। তবে কচ্চিৎ কদাচিৎ। শুধু কলকাতা নয় সারা বাঙলার বুকেই ফেরিওয়ালাদের মাঝে মধ্যেই দেখা পাওয়া যায়।
তবে এই ফেরিওয়ালার ডাক প্রথম কলকাতার বুকে কবে শোনা যায়? কী পসরা সাজিয়ে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথম ফেরিওয়ালাদের দেখা পাওয়া যেত বা কী বা তাদের সুর ছিল? এই বিষয়ে খুব কম অনুসন্ধান হয়েছে। তবে যেটুকু জানা যায় যে কলকাতার বুকে ফেরিওয়ালাদের প্রথম ছবি আঁকেন বেলজিয়ান শিল্পী বাল্ থাজার সল ভিনস। ১৭৯৯ সালে কলকাতায় ছাপা তাঁর ‘ এ কালেকসান অফ ট্রু হানড্রেড অ্যান্ড ড্রেসেস অফ দি হিন্দুজ‘ বইয়ে কিছু ছবি প্রথম প্রকাশিত হয়। পুরনো কলকাতায় নানা অঞ্চলে পাড়ায় পাড়ায় অজস্র ফেরিওয়ালা ঘুরত তাদের সম্পর্কে খুব কম লোকজনই আলোচনা করেছে। কলকাতার বুকে ফেরিওয়ালাদের ডাক আর আওয়াজ সম্পর্কে রসরাজ অমৃতলাল বসু কিছু আলোকপাত করেছেন তাঁর অসম্পূর্ণ ‘স্মৃতি কথা পুরাতন’ পঞ্জিকায়। এই পঞ্জিকার লেখাটি ‘বসুমতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩৩০ থেকে ১৩৩১ সালের মধ্যে। তিনি উল্লেখ করেছেন শ্যামবাজার স্ট্রিট, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট এই সব রাস্তা দিয়ে এক কালে সকাল বেলা গোরার পল্টন সেপাইয়ের পল্টন, ঘোড়সওয়ার পল্টন কামানের গাড়ি শব্দ তুলে যেত। কম্বুলে টোলায় লোকজনের কানে ভেসে আসত ‘কু উ উ উ ও ও ওর ঘ টি তো ও ও লা’ অর্থা কুয়োর ঘটি তোলা। কারণ কলকাতায় একটা সময়ে টাইম কলের জলের ব্যবস্থা ছিল না। তখন সব বাড়িতেই এক, দুই বা তার বেশী কুয়ো থাকত।
আসলে কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে অনেক রকম ঘটনা বা বিষয় উঠে এসেছে। কিন্তু ফেরিওয়ালা বা রাস্তায় বিভিন্ন রকম যে আওয়াজ পাওয়া যেত তার জায়গা দখল করেছে বর্তমানে যান বাহনের শব্দ। যাই হোক পরবর্তী সময়ে অমৃত লাল বসু আরও বিস্তৃতভাবে বলেছেন যে সকাল সাড়ে ন’টা থেকে পাড়ায় ধোপ দুরস্ত কাপড় পরিষ্কার মেরজাই আর জরিবসান টুপি পরা দেশলাইওয়ালা ‘লে দেশ্লাই’ বলে হেঁকে যেত। শুনতে অবাক হলেও এটাই মজার বিষয় কলকাতার বুকে এক সময় দেশলাইও হেঁকে বিক্রি করা হত। প্রথম প্রথম সব বিষয়েই মানুষের আশঙ্কা থাকে। ঠিক তেমনি রাস্তার বুকে ফেরি করে দেশলাই দেখে তখনকার সময়ে মানুষ জনের মনে নানা ধরনের ভয় আর সন্দেহ দেখা যায়। “এ আবার কি সর্বনেশে জিনিস এল রে বাবা!” এমন মন্তব্যও শোনা যায়। এখনকার সমাজ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত হয়ে গেছে যে কলকাতার বুকে ফেরিওয়ালা প্রায় দেখাই যায় না।
১৯৮২ সালের শারদীয়া মহানগর পত্রিকায় শ্রী অতুল চন্দ্র সুরের একটি প্রবন্ধে কলকাতার বুকে মেয়ে ফেরিওয়ালার কথা প্রথম জানা যায়। মেয়ে ফেরিওয়ালাদের পরিচিত ডাক ছিল “মিশি লেবে গো।” বাড়ির বয়স্ক বৃদ্ধারাই দাঁতে মিশি দিতেন। এখন এই সব কলকাতার বুকে প্রায় বিলুপ্তই বলা ভালো। সেই সময় আরও কিছু ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যেত। অমৃতলাল বসুই জানিয়েছেন এই রকম কয়েকটা ফেরিওয়ালার ডাক সম্পর্কে যেমন ‘সরাগুড় তিলকুটো সন্দেশ, ‘মুকুন্দ মোয়া’, ‘বাত ভাল করি’, ‘দাঁতের পোকা বার করি’,’চাই ঘোল’, ‘মাজন মিশি মাথা ঘষা’ ‘চাই শাঁখা’, ‘চাই সিন্দুর’,’ চাই মধু’, ‘ধনে সরষে লেবে গো’, ‘চাই শুকনো দই’ ইত্যাদি নানা রকম হাঁক ডাকে পসরা সাজানো ফেরিওয়ালাদের পাওয়া যেত কলকাতার বুকে। এখন আমাদের শহরটা মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল, মিনি স্টোর আউট লেটেই ভরে উঠেছে। তাই ফেরিওয়ালাদের ওই বাজারে বা মাঝে মধ্যে পাড়ায় দেখা গেলেও তা খুবই নগণ্য।
চিত্র ঋণ – বেলজিয়ান শিল্পী বাল্ থাজার সল ভিনসের বইতে কলকাতার বুকে আঁকা ফেরিওয়ালাদের ছবি
Discussion about this post