২০০ বছরের রাজত্বে ব্রিটিশরা নিজেদের প্রয়োজনে বাংলা সহ ভারতবর্ষে বেশ কিছু নির্মাণ কাজ করেন। ব্যবসা সহজ পথে করার জন্য পরিবহন ব্যবস্থার বেশ উন্নতি করেন তারা। তারই মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ১৯১০-১৫ অবধি ৫ বছর ধরে প্রায় ২৪ হাজার শ্রমিক মিলে তৈরি হয়েছিল এই ব্রিজ। রবি ঠাকুর থেকে রানী রাসমণির মতো অনেকেরই রংপুরের জমিদারি তদারকি সহজ করে তুলেছিলো এই ব্রিজ।
১৮৫৭ তে বাংলায় প্রথম রেল স্টেশন তৈরি হয়। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার পোড়াদহ পর্যন্ত তৈরি হয় রেলপথ। এরপর সাঁড়াঘাট থেকে ফেরী পারাপার করে বাকি পথ। সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি অবধি রেলপথ নির্মাণ হলে সাঁড়াঘাট হয়ে ওঠে বাংলার বৃহত্তম কর্মচঞ্চল নৌবন্দর। কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গের প্রধান ও একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল এই পথ। সাঁড়ায় তখন ১৬ টি ঘাট ছিল। সাঁড়াঘাট স্টেশন ছিল সেই সময়ের অন্যতম ব্যস্ত স্টেশন। তবে সেই সময়ের পদ্মার স্রোত ছিল ভয়ানক। স্টিমারে করে মাল পারাপার ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সুন্দর করার জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত হয়ে ওঠে নিরবিচ্ছিন্ন আর দ্রুততম। প্রয়োজন ফুরোয় সাঁড়াঘাটের। এই জায়গার নাম পরিবর্তন হয়ে এখন হয়েছে পাকশী।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১.৮ কিমি। এখনও অবধি এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু। তৎকালীন সময়ে বড়লাটের নাম অনুসারে এই সেতুর নামকরণ হয়। শুরু হল ঐতিহাসিক দার্জিলিং মেলের যাতায়াত। কলকাতা-পার্বতীপুর পথে যাত্রা শুরু হয় নর্থ বেঙ্গল মেলের। ব্রিজ শুরু হয় পাবনার এই পাকশী এলাকা থেকে। ব্রিজের কাজে সবসময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দরকার ছিল। পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে দুটি পাওয়ার হাউজ বসানো হয়। ব্রিজের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য পাওয়ার হাউজের পাশে একটি ব্লক ইয়ার্ড স্থাপন করা হয়। যেখানে কংক্রিটের ব্লক তৈরি করে রেললাইনের মাধ্যমে ছোট লরি দিয়ে ব্রিজের পাদদেশে নিয়ে যাওয়া হতো। কলেরা প্রতিরোধে পরিষ্কার জলের প্রয়োজন দেখা দিলে এখানেই স্থাপিত হয় জল শোধনাগার। ব্রিজ তৈরির সময় গাইড ব্যাংকের পাশেই তৈরি হয় সুন্দর এক দোতলা বাড়ি। সেতুর প্রধান প্রযুক্তিবিদ রবার্ট গেইলসের থাকার জন্য। এর আশেপাশের এলাকায় অন্যান্য অফিসারদের কোয়ার্টার গড়ে ওঠে। নাম হয় সাহেব পাড়া। অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য গড়ে ওঠে বাবুপাড়া, মেরিনপাড়া, মুচিপাড়া। রেইন ট্রি লাগিয়ে পুরো সবুজে ঢেকে দেওয়া হয় পাকশী নগরী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, শিশু পার্ক সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে অভিজাত রেলনগরী। সেই সময়ের বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের সদর দফতর ছিলো পাকশী। কালের বিবর্তনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সাঁড়াঘাট।
সম্পূর্ণ ইস্পাতের তৈরি এই ব্রিজ সেই সময় বহু মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। সদ্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা এবং পূর্বাঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে ভরসা ছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এরপর হয় দেশভাগ, কলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা দিক বদলায়। একসময়ের জমজমাট পাকশী স্টেশন এবং পাকশী নগরীর জৌলুস কমতে থাকে। এখন সেসব নিদর্শন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে ঢাকা থেকে রংপুরগামী ট্রেন আজও হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে সচল রেখেছে।
Discussion about this post