ধরুন, সূর্য এক্কেবারে মাথার ওপর তখন। ওয়েলেসলির মোড় থেকে সারি সারি লাল বাড়ি বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে চলেছেন। আপনার ডানদিকে অনেক গাছ, আর ডাল থেকে ঝুলছে অগুনতি লাশ। কেমন লাগবে আপনার? সময়টা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, সময়কে পাড়ি দিয়ে ইতিহাস জানান দেয়, জব চার্নক তখনোও জীবিত। ইংরেজদের শাসনকালে, এহেন লাশ ঝোলার ঘটনা ছিল এক উদ্ভট ঘটনার অংশ। মায়াবী কলকাতার এহেন রহস্যের গল্পটা অন্য রকম। ওয়েলেসলী থেকে কাউন্সিলস মোড়ের দিকে যেতেই পড়ে ফ্যান্সী লেন। এ সময়ে ইংরেজদের শাসনের এক অন্যতম শাস্তি ছিল গরীব অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো। গরীব ভারতীয়দের ছটফটানো মৃতদেহ দেখে তাদের হত মজা!
প্রায় কয়েকবছর ধরে এই মৃত্যুর লীলা খেলায় মারা গিয়েছেন প্রচুর মানুষ । এদের মধ্যে একজনের ঘটনা জানা যায় শ্রীপান্থের লেখা, ‘কলকাতা’ বইটি থেকে। ব্রজকুমারের চুরি। একটি পঁচিশ টাকার ঘড়ি চুরি করার অপরাধে তার ফাঁসির শাস্তি হয়। শাস্তির স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় লম্বা গাছযুক্ত রাস্তা। এই লেনের নাম তখন থেকেই হয় ফ্যান্সী লেন। ফাঁসি শব্দের ইংরেজি অপভ্রংশ হয়ে ওঠে এই শব্দ ‘ফ্যান্সী’ কিংবা ‘Phancy’। আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে সেই সময়ের কথা বর্ণনা করে গিয়েছেন। জব চার্নক প্রথম এসেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা এলাকায় লুঠতরাজ চালানো ঠগী-বর্গীদের। এদের অত্যাচার ছিল ব্যবসার অন্তরায়। কলকাতার অন্যতম পুরনো এই রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যেত এক খাল আর এই রাস্তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে অনেক ভয়ঙ্কর গল্প নদী। এরকম আরেকজন আসামী ছিলেন নন্দকুমার। যার লঘু অপরাধের শাস্তি হয়েছিল ফাঁসি, হেস্টিংসের ষড়যন্ত্রে। অবিচারের শিকার এই ফাঁসির ঘটনা দেখে সবাই ফিরেছিল গঙ্গা স্নান করে। কারণ নন্দকুমার ছিল ব্রাহ্মণ আর ব্রহ্মহত্যা দেখার পাপের অবসান হবে গঙ্গাস্নানে । লুঠতরাজ চালানো বর্গী থেকে সাধারণ দরিদ্র যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন তার শাস্তি ছিল ফাঁসি। বইগুলো থেকে আরোও জানা যায়, শাস্তি উপলক্ষে বসত মেলা। ফাঁসি মঞ্চ তৈরী হতো, বসত ঢেঁড়া। এই ঢেঁড়া পিটিয়েই রীতিমতো আগে থেকেই ঘোষণা করা হতো কবে কার ফাঁসি হবে।
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই এই জমিদারী বিচার চলতো, যার কেন্দ্রে বসত কোন ইংরেজ আর সঙ্গ দিতেন ভারতীয় ‘ব্ল্যাক’ কোন জমিদার। এই ‘ব্ল্যাক’ জমিদার কথাটি আসলেই ছিল এক সামাজিক পদস্তরের উপাধিস্বরূপ। কল্লোলিনী কলকাতার কোলাহলে আজ চাপা পড়ে গিয়েছে সব অমানবিক যন্ত্রণা। বিভীষিকাময় পর্বের হয়েছে অবসান। এখন কেবলমাত্র স্পষ্ট হয়ে রয়েছে কংক্রিটের এই ফ্যান্সী লেন।
Discussion about this post