শ্যামা মা কি আমার কালো রে, শ্যামা মা কি আমার কালো”- মা কালী বলতেই মায়ের যে রূপটি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তা হল কৃষ্ণবর্ণা ও চতুর্ভূজা। তবে চণ্ডীপুরাণ অনুযায়ী, অসুর বধের সময়ে দেবী দুর্গা অনেক রূপ ধারণ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম তাঁর হাজার-হাতের রূপ। চণ্ডীপুরাণের সেই বর্ণনা অনুযায়ী নির্মিত হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলের ওলাবিবিতলার হাজার-হাত কালীমন্দির।
এ এক অত্যাশ্চর্য মূর্তি- প্রায় পঁচিশ ফুট উঁচু নীলাভ সবুজ বর্ণা দেবীর বাঁ হাতে খড়গ ও ডান হাতে পঞ্চশূল এবং বাঁ পা সিংহের উপরে ও ডান-পা পদ্মফুলের উপরে। দুটি পা দু-দিকে থাকার অর্থ মা সবসময় জলেও রয়েছেন, স্থলেও রয়েছেন। মা কালীর এই রূপ সচরাচর দেখা যায় না। জিহ্বা মুখের বাইরে নেই। করাল বদনা রূপের পরিবর্তে দেবীর মুখে ফুটে ওঠে শান্ত রাগহীন এবং দৃঢ়চেতা অভিব্যক্তি। তাঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এক হাজারটি হাত। এই অঞ্চলে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিষ্ঠাভরে হয়ে আসছে এই হাজার হাতের মা কালীর পুজো। এই মন্দিরের নামানুসারেই বহুকাল আগে থেকে অনেকের কাছে এই অঞ্চলটি হাজার হাত কালীতলা নামেও প্রসিদ্ধ। শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে নানান জনশ্রুতি। শোনা যায়, আজ থেকে প্রায় ৬০-৬৫ বছর আগে এই মন্দিরে প্রার্থনা করে দক্ষিণ ভারতীয় এক ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। তারপর থেকে সারা দক্ষিণ ভারত জুড়ে তিনি মায়ের মাহাত্ম্য প্রচার শুরু করেন। স্থানীয়রাও ভক্তিভরে বিশ্বাস করেন হাজার-হাত কালী খুবই জাগ্রত। নিষ্ঠা ভরে কেউ কিছু চাইলে মা কালী নাকি কাউকে ফেরান না।
বলি প্রথার প্রচলন নেই এখানে। প্রাচীন প্রথা মেনে আজও মুখোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা এখানে পুজো করে আসছেন। এই মন্দিরের সেবক প্রতাপ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নিত্যপুজোর পাশাপাশি বুদ্ধ পূর্ণিমা ও দীপাবলিতে এখানে বিশেষ পুজো হয়। হাজার হাজার ভক্তের ঢল নামে এই বিশেষ দিনগুলোতে। কালীপুজোর দিনে ভিড় এতটাই হয় যে পরিস্থিতি সামাল দিতে নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করতে হয়। মায়ের ভোগেও রয়েছে বিশেষত্ব। তারাপীঠ- এর মত আমিষ ভোগ অর্থাৎ মাছ, মাংস, পোলাও এসব তো আছেই। কিন্তু ইডলি-সম্বর দিয়ে কালী ঠাকুরের পুজো, শুনেছেন কখনো? আজ্ঞে হ্যাঁ, শোনা যায়, শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষে ইডলি-সম্বর সহযোগে তামিল ভোগেও মা সন্তুষ্ট হন।
হাজার-হাত কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়েও অনেক ইতিহাস রয়েছে। ১৮৭০ সালের কথা। কলকাতার চোরবাগানের স্থানীয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নামক এক তান্ত্রিক স্বপ্নে কালীর এই হাজার-হাতের রূপ দেখতে পান। এমনকি ওলাবিবিতলায় যেখানে আজ এই মন্দির গড়ে উঠেছে সেই জায়গাটিও স্বপ্নে দেখেছিলেন তিনি। তিনি সেই স্বপ্নাদেশ মোতাবেক ওলাবিবিতলায় খুবই সামান্য অর্থে তিন কাঠা জায়গা কিনে ও স্থানীয় হালদার পরিবারের অর্থসাহায্য নিয়ে একটি মাটির মন্দির তৈরি করেন। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই মন্দির। অর্থসংকটের দরুণ দুটি মাটির হাত ছাড়া বাকি ৯৯৮ টি হাত মাটির দেওয়ালে আঁকা ছিলো। পরবর্তীকালে অনেক চেষ্টা করে পাকা মন্দির এবং সিমেন্টের প্রতিমা তৈরি হয়। সেই থেকে তন্ত্র মতে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী। হাওড়া স্টেশন থেকে খুব সহজেই ৫২ নং বাসে করে মন্দিরতলায় এসে একটা টোটো নিয়ে দর্শন করে যেতে পারেন মায়ের এই হাজার হাতের রূপ।
Discussion about this post