বেহালা খুব প্রাচীন একটা জনপদ। কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নিয়ে যখন আমাদের কোলকাতা গড়ে ওঠেনি, তখন থেকেই বেহালা অঞ্চল ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। আজকের বেহালার ছবিটা অনেকটাই আলাদা। শহুরে ছাপ পড়েছে সর্বত্র। এখানকার ব্রাহ্ম সমাজ রোডের মুখার্জী বাড়িতে রয়েছে এক সোনার দুর্গা। প্রতি বছর ধূম-ধাম করে দুর্গাপুজোও হয়। পল্লীর প্রবীণরা এখনও এই বাড়ির ‘ভাতে ভবানী’ ও ‘সন্দেশের শিবু’র স্মৃতি চারণ করেন। অর্থাৎ এই পরিবারেরই ভবানী মুখোপাধ্যায়ের আমলে এখানে ভাতের আর শিবু মুখোপাধ্যায়ের আমলে এখানে সন্দেশের পাহাড় তৈরী হত।
বেহালায় এসে পরিবারের কর্তা জগৎরাম মুখোপাধ্যায় এই পুজোর পত্তন করেন। উনি এসেছিলেন যশোর জেলার ঝিকরগাছা থেকে। জগৎরামের জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। যশোর জেলায় তিনি সংসার করছেন, মাত্র ৩০ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু শ্মশানঘাটে হঠাৎই তিনি আবার প্রাণ ফিরে পান। মৃত্যুর পর আবার বেঁচে ফেরার জন্য, তৎকালীন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ তাকে মেনে নেয়নি। অগত্যা গঙ্গার এ পারে এসে বেহালা চত্বরে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে অযোধ্যা হালদারের মেয়েকে বিয়ে করেন নতুন সংসার শুরু করেন।
পুজোর ঘটনাটা শুরু হয় ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। জগৎরামের চার ছেলে ও একমাত্র কন্যা জগত্তারিণী, প্রত্যেকবারের মতো সে বছরও গেছে মামার বাড়ির দূর্গাপুজোতে। কিন্তু আদরিণী মেয়ের মনে হল, তাকে যেন কিছুটা অবহেলা করা হচ্ছে সেখানে। অভিমান নিয়ে অষ্টমীর দিন বাড়ি ফিরে এলো সে। বাবাকে জানালো সেও বাড়িতে দূর্গাপুজো করতে চায়, আর সেটা এই বছরেই। মেয়ের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে পরের দিন অর্থাৎ নবমীতেই ঘটে-পটে পুজো করলেন জগৎরাম।
পুজোর সেই শুরু। তখন ঘটে-পটেই হতো পুজো। জগৎরামের নাতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায় কর্মসূত্রে ছিলেন ঢাকায়। সেখানে থাকাকালীন ঢাকেশ্বরীর মূর্তি দেখে মনস্থির করলেন, কলকাতার বাড়িতে সেই আদলে সোনার দূর্গা মূর্তি গড়বেন। কিন্তু শুধু সোনার তৈরি প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। তাই অষ্টধাতু সংযোগে মাতৃমূর্তি স্থাপিত হলো ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই বেহালার বাড়িতে। তার পর থেকেই, এই সোনার প্রতিমাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে প্রতি বছরের দুর্গোৎসব। পুজো হয় তান্ত্রিক মতে, তাই বলির প্রচলন আছে। পশুবলি হয়, সঙ্গে চালকুমড়ো ও আখ বলিও হয়।
এই প্রসঙ্গে বলি, এই বাড়িতে কোনো সন্ধিপুজো হয় না। এর নেপথ্যে আছে একটা অদ্ভুত কাহিনী। অনেক বছর আগে সন্ধিপুজোর পূর্বে পুজো প্রাঙ্গণে একটি ছোট্ট মেয়ে লাল শাড়ি পরে খেলছিল। কিন্তু পুজোর পর তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন অদ্ভুত ভাবে সবাই দেখতে পায়, দুর্গা মূর্তির ঠোঁটের কোণে এক টুকরো লাল কাপড়, যা ছিল সেই বালিকার শাড়ির অংশ। এই বাড়ির সন্ধিপুজো বন্ধ হয়ে যায়, সেই অলৌকিক ঘটনার পর থেকে। নবমীর দিন হয় একটি বিশেষ পুজো, যার নাম ‘সধবা পূজা’। এখানে পরিবারের জ্যেষ্ঠা সধবা যিনি, তারই পুজো করা হয়। একটি বিশেষ স্তোত্র যার নাম ‘বটুক ভৈরব’, সেটি দশমীর বিদায় সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়। এরপরে পারিবারিক পুকুরে নবপত্রিকা ও ঘট বিসর্জন দিয়ে, বাৎসরিক দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এরপর আসা যাক মায়ের ভোগনিবেদনের বিষয়ে। ভোগের একটি বিশেষত্ব হলো, প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত প্রতিদিনই ফল-মিষ্টি সহযোগে মায়ের আরতি হয়। এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য পোড়া মাছের ভোগ। সকালে হয় খিচুড়ি ভোগ, দুপুরে সাদা ভাত, ডাল, তরকারি এবং অবশ্যই ‘মাছপোড়া’ (ল্যাটা, সিঙ্গি, মাগুর বা অন্য কোনও মাছ)। বিজয়ার দিন দেওয়া হয় পান্তা-ভোগ, যা নবমীর রাতে ভাতে জল ঢেলে বানানো হয়। এর সাথে থাকে কচু-ঘন্ট, মাছপোড়া আর চালতার অম্বল। যেহেতু কৈলাস অনেকটা লম্বা পথ, তাই সেই যাবার পথে খাবার জন্য ‘কন্যারূপী’ মাকে দেওয়া হয় দই, খই, মুড়কি ও চিড়ে। আর হ্যাঁ, বিসর্জনের অনুষ্ঠানে থেঁতো পান খাওয়ানো হয়।
Discussion about this post