১৯৪৫, জাপানের ইতিহাসে এক বিষাক্ত বছর। সে বছর ৬ অগাস্ট ও ৯ অগাস্ট মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরের ওপর আছড়ে পড়ে মার্কিনি পারমানবিক বোমার আঘাত। সে বিস্ফোরণের কবলে প্রাণ হারান ২ লাখের বেশি মানুষ। এখানেই শেষ নয় পর বিস্ফোরণের পরের তেজস্ক্রিয়তা ছিল আরও মারাত্মক। তেজস্ক্রিয়তার কারণে তার পরের কয়েক বছর জাপানে অসংখ্য বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়। ঠিক এরকমই এক বিকলাঙ্গ শিশুর দলে ছিল সেও। হিরোশিমার সাদাকো সাসাকি।
বয়স তখন মাত্র দুই, এল জাপানের সেই কালো দিন। সেদিন বিস্ফোরণের হাত থেকে প্রায় ভাগ্যক্রমেই বেঁচে গিয়েছিল সে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে সেসময় ‘লিউকিমিয়া’ও সেখানে অতি পরিচিত এক অসুখ হিসাবেই গণ্য হতে থাকে। সাদাকোর শরীরেও তখন বাসা বাঁধে লিউকিমিয়া। পরবর্তী দশ বছর হাসপাতালেই চলে ছোট্ট সাদাকোর সঙ্গে লিউকিমিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ। এরই মধ্যে একদিন হাসপাতালে দেখা করতে এল বান্ধবী সিজুকো। সে তখন এক জব্বর বুদ্ধি দিল সাদাকোকে। এক হাজার কাগজের অরিগ্যামি সারস বানালে নাকি তা বয়ে আনবে সৌভাগ্য। সে যা চাইবে ঠিক তাই নাকি পাবে। এমনকি সে সুস্থও হয়ে উঠতে পারে। ব্যাস! আশায় বুক বেঁধে ময়দানে নামল সাদাকো সাসাকি। তবে শেষ রক্ষা আর হয়নি! লক্ষ্য ছিল হাজার কাগজের সারস বানানোর। তবে সে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করা হল না তার। ১৯৫৫’তে সাড়ে ছ’শো সারসে এসেই থেমেছিল তার জীবনরথের চাকা।
তবু আজও বেঁচে রয়েছে সাদাকোর তৈরি সারসেরা। হোক না সে কাগজের! তবু শক্তির লড়াইয়ে অতি সামান্য কিছু মানুষের আশার আলো হয়েই বেঁচে রইল তারা। হিরোশিমায় সাদাকোর বানানো সারসগুলি শান্তি ও আশার প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে আজও। সাদাকোর স্মৃতিতে ১৯৫৮ সালে জাপানের হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে একটি ভাস্কর্যও স্থাপন করা হয়৷ যেখানে তার হাতে রয়েছে একটি সোনালি রংয়ের সারস৷ যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল পিস পার্কেও রয়েছে তাঁর আরেকটি ভাস্কর্য৷ তার স্মরণে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা রঙের সারস তৈরি করে পাঠানো হয়। সেগুলোকে কাঁচের পাত্রে রেখে প্রদর্শনী করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের পার্ল হারবারের ইউএসএস অ্যারিজোনা মেমোরিয়ালেও সাদাকোর তৈরি সারস প্রদর্শিত হয়।
পরমাণু যুদ্ধের পর ২০১৬ সালে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে হিরোশিমা সফরে আসেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ সেসময় তিনিও কাগজ দিয়ে চারটি সারস পাখি বানিয়েছিলেন। ওবামার তৈরি সারসগুলি হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে সযত্নে রাখা রয়েছে আজও। আসলে সাদাকো না বাঁচলেও হিরোশিমার মানুষের মধ্যে আজও বেঁচে রয়েছে তার বিশ্বাস এবং আশা। বেঁচে রয়েছে সেই ছোট্ট মেয়েটির বানানো সারসগুলির মধ্য দিয়েই। সে বিশ্বাসই হয়তো আগামীদিনের ভরসার হদিশ দেয় তাদের। এমনটাই যদি হয় হোক না। ক্ষতি কি!
চিত্র ঋণ – DW Bengali
Discussion about this post