পুরুলিয়া জেলার শিল্প আমাদের মোহিত করেছে বরাবর। হাতের কাজে তাদের দক্ষতা পশ্চিমবঙ্গকে বারবার পুরস্কৃত করেছে বিশ্ব দরবারে। ছৌ নাচ থেকে হাতের তৈরী মুখোশ, কুটিরশিল্পে এই জেলা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে বরাবর। তাই পাহাড়ে ভরা এই জেলার শিল্পজ্ঞান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরুলিয়া জেলার এমন এক অত্যাশ্চর্য জিনিস হলো ‘ঘঙ’ বা ‘ঘোঙ’। বাস্তবে যা একটি বর্ষাতি বা রেনকোট। পাহাড়ি এই জেলায় বর্ষায় বৃষ্টি হয় প্রবল। যার ফলে মাঠে চাষের কাজ বিঘ্নিত হয়। দিনের পর দিন শস্যের যত্ন নিতে সমস্যা হয়। তাই এখানকার স্থানীয় চাষীরা নিজেরাই প্রাকৃতিক ভাবে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন কয়েকশো বছর আগেই।
গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে তাঁরা সংগ্রহ করেন ‘চিহড়’ পাতা। এই পাতাগুলো রোদে শুকোতে দেওয়া হয়। যখন ধীরে ধীরে পাতার রঙ পরিবর্তন হয়, সবুজ থেকে হালকা তামাটে হয়ে যায় , তখন বাড়ির মহিলারা এগুলোকে বাঁধতে থাকেন। সজারুর কাঁটা সংগ্রহ করে এবং দু’দিক পালিশ করে ব্যবহার করে এই ‘ঘঙ’ বুনতে। প্রথমে একটা পাতা, তার পরে আরো দুটো পাতা, আবার তার পর তিন চারটে পাতা। এভাবে এই ঘঙ বানাতে থাকেন তারা। আষাড় মাসে বেলপাহাড়ী থেকে ১২ কিমি দূরে ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মিলিত কানাইসর পাহাড় পুজো মেলায় এই পাতার টুপি বিপুল বিক্রি হয়। বেলপাহাড়ী অঞ্চলের কোথাও কোথাও আদিবাসীদের মধ্যে নিজেদের ব্যাবহারের জন্য ঘঙ তৈরি হয়।
পরিবারের প্রায় সব মহিলারাই হাত লাগান এই কাজে। সবাই মিলে খানিকটা আড্ডার ছলে এই কাজ করতে থাকে। ধীরে ধীরে এই ঘঙ একটি ত্রিভুজাকৃতি পিরামিডের আকার নেয়। অপূর্ব এই কুটিরশিল্পের এরপর বাস্তব ব্যবহার শুরু হয়। বর্ষা নামলে এই বর্ষাতি ব্যবহার করে তারা নেমে পড়ে কাজে। এক একটি ঘঙের ওজন হয় প্রায় তিন-চার কিলো। বেশ ভারী এই ‘ঘঙ’ ব্যহার করাই এখানকার চাষীদের রীতি। বর্তমানে অবশ্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কৃত্রিম ঘঙ বিতরণ করেন। চাষীদের সুবিধার্থে অন্য বিভিন্নরকম সিন্থেটিক উপাদানের তৈরী বর্ষাতি বা রেনকোট তাদের কাছে পৌঁছে দেন। ফলে চাষীরা এই হালকা ঘঙ ব্যবহার করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। পুরুলিয়ার এই কুটির শিল্প তাই এখন আস্তে আস্তে বিলুপ্তপ্রায়। আধুনিকতার থাবায় হারিয়ে যাচ্ছে এই চিহড় পাতার ঘঙ।
চিত্র ঋণ – সুদীপ পাত্র, সমুদ্রগুপ্ত মল্লিক
Discussion about this post