কলুর বলদ যে সমাজের এক রূপ তা তো বিশ্বকবি কবেই বলে গিয়েছেন। তাঁর ‘কর্তার ভূত’ গল্পে বুড়ো কর্তা মরেন না ঠিকই কিন্তু বাস্তবে মরতে বসেছে ঘানি শিল্প। প্রায় মৃত ঘানি শিল্পের শুরুটা বেশ পুরনো। প্রায় ২৩০০ বছর আগে মৌর্য শাসনকালে খরার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। সে সময়ে জনগণের মধ্যে খাদ্য হিসেবে ধান এবং তেলবীজ দেওয়া হয়। বিশেষ করে তিল ও সরিষার বীজ।
সেই থেকেই তেল উৎপাদন নাম লেখায় পেশা হয়ে ওঠার খাতায়। কিন্তু সমাজ তেল উৎপাদনকারীদের মোটেই সম্মানের চোখে দেখেনি। বরং অবজ্ঞা করে তাদের পরিবারকে ‘তেলি বা তৈলিক’ নামে ডাকা হতো। পরবর্তীতে এরাই পরিচিত হয় ‘কলু’ নামে। যার উৎপত্তি হিন্দি শব্দ ‘কলহু’ থেকে। তিল বা শরিষা সংগ্রহ, শুকানো, সেদ্ধ করা, ঢেঁকিতে মাড়াই করা কাজে শুরুর দিকে যথেষ্ট সময়ই ব্যয় হতো। তা থেকে হাতে চেপে তেল তৈরি করাও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। পরে আবিষ্কার হয় তেলবীজ মাড়াই করার হস্তচালিত যন্ত্র ‘ঘানি’। এটি মূলত গর্ত যুক্ত কাঠের গুঁড়ি যার ভেতর একটি মজবুত কাঠের দণ্ড ঘুরে চলে আপন খেয়ালে। কাঠের গুঁড়ির এক অংশ থাকে মাটির নীচে এবং আরেক অংশ ওপরে। এ যেন ধরিত্রীমাতার বুক চিরে আয়ের রাস্তা খুঁজে নেওয়ার উপায়।
মাঝে থাকা ভারী দণ্ডটিকে ঘোরানোর জন্য থাকে এক জোড়া শক্তিধর বলদ। সমাজের বেগার খাটা মানুষের ন্যায় তাদের চোখেও বেঁধে দেওয়া হয় কাপড়। খাটুনির পরিমাণ বুঝে ছুটে পালিয়ে যাবার উপায় আড়াল হয়ে যায় সেই কাপড়ের পেছনে। বহুল প্রচলিত ‘কলুর বলদ’ প্রবাদটি মূলত এভাবেই এসেছে। তেলবীজ পিষে তেল পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাঠের গায়ে থাকে তিন কোণা নালা পথ। এই তেল বিক্রির পদ্ধতি ছিল অন্যরকম। এই তেল বিক্রি করা হতো ফেরি করে। ঠকে যাতে না যেতে হয় তাই বাড়ির সবচেয়ে চতুর পুরুষকে ফেরির দায়িত্ব দেওয়া হতো। মানুষের অগাধ আস্থা ছিল ঘানির তেলের ওপর। পাকা বাঁশের তৈরি বাঁক বা ভাঁড়ের এক পাশে হাঁড়িতে করে তেল এবং অন্য পাশে রবি শস্য নিতো তেল বিক্রির বিনিময় মূল্য হিসেবে।
বর্তমানে মেশিনে তেল তৈরি হয়। তাতে ভেজালও টের পাওয়া যায় বেশ। প্রযুক্তির সাথে সমানুপাতিক ভাবে বেড়ে চলেছে রোগ এবং রোগীর সংখ্যা। তবে সে সময়ে ভেজাল একেবারে ছিল না বলাও ভুল হবে। বেশি লাভের আশায় সর্ষের বীজের সাথে মিশে যেতো তিল, তিশি, রেড়ি বা ভিন্ন জাতীয় তেলবীজ। বিজ্ঞাপনের আলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে ঘানি শিল্প। যেখানে এক লিটার তেল তৈরিতে সময় ব্যয় হতো একদিন বা কয়েক ঘন্টা। বর্তমানে সেখানে ব্যয় হয় মাত্র কয়েক মিনিট। তাই অযাচিত চিন্তা থেকেই যায়, তৈরি হতে সময় কম হলে জীবন যেতেও সময় কম লাগবে কি? এ প্রশ্ন থেকেই যায় ।
Discussion about this post