সে বহু বছর আগের কথা। উত্তর ওয়েলসের বেডগেলার্ট নামে একটি গ্রামে এক রাজপুত্র বাস করতেন। নাম ছিল লিওয়েলিন। তাঁর এক পোষ্য ছিল, এক হাউন্ড কুকুর। কুকুরটিকে ইংল্যান্ডের রাজা জনের থেকে উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন লিওয়েলিন। রাজপুত্র তার নাম রাখেন গেলার্ট। পোষ্যটি রাজপুত্রের এতটাই পছন্দের ছিল যে, তাকে কখনও নিজের কাছ ছাড়া করতেন না তিনি। অন্যদিকে নিজের মনিবের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকত গেলার্টও। রাজপুত্র লিওয়েলিন ও গেলার্ট দু’জনেই যেন ছিল হরিহর আত্মা!
লিওয়েলিনের অন্যতম এক শখ ছিল শিকার করা। প্রতিবার শিকারে যাওয়ার সময় গেলার্টকে সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন তিনি। শিকারে বেরোনোর আগে তিনি বিশেষ এক ধরনের ভেঁপু বা বাঁশি বাজাতেন। সেই শব্দে গেলার্ট সহ আর আরও পোষ্য কুকুরগুলি ছুটে চলে আসত। তারা ঠিক বুঝতে পারত যে এটি শিকারে যাবার সংকেত! ঠিক এরকম ভাবেই দিন কাটতে লাগল রাজপুত্র ও গেলার্টের। তারপরই এল সেই কালো দিন! ঘটল সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। রাজপুত্র সেদিন শিকারে যাওয়ার আগে নিয়ম মতো বাঁশির আওয়াজ করলেন। আওয়াজের শব্দে আর সব পোষ্যগুলি চলে এলেও এল না শুধু গেলার্ট। চারিদিকে খুঁজেও যখন তার দেখা পাওয়া গেল না, তখন কিছুটা বিমর্ষ হয়েই তাকে ছাড়া শিকারে যেতে হল রাজপুত্রকে। সেই সময় রাজপ্রাসাদে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর এক বছর বয়সী পুত্র।
দিনের শেষে শিকার সেরে প্রাসাদে ফিরলেন লিওয়েলিন। তিনি ফিরতেই তাঁর কাছে দৌঁড়ে এল গেলার্ট। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে গিয়ে রাজপুত্র দেখতে পেলেন গেলার্টের সারা শরীরে আঁচড়ের দাগ! চোয়াল বেয়ে লাল টকটকে তাজা রক্তও ঝরে পড়ছে। অজানা এক আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠলেন রাজপুত্র। দৌড়ে চলে এলেন নিজের ঘরে। পিছু পিছু এল গেলার্টও। ঘরে ঢুকতেই তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। তিনি দেখলেন সমস্ত ঘরের অবস্থা প্রায় বেহাল। চারপাশ লণ্ডভণ্ড। এমনকি তার ছেলের বিছানাও ওলট-পালট হয়ে রয়েছে। অথচ এদিক ওদিক খুঁজেও ছেলেটির কোনো চিহ্নই তিনি দেখতে পেলেন না। এইবার রাজপুত্র ভয়ানক রেগে গেলেন। তিনি ভাবলেন গেলার্টই নিশ্চয়ই তার অনুপস্থিতিতে তার সন্তানকে আঁচড়ে কামড়ে মেরে ফেলেছে! ব্যাস! আর দেরি করলেন না তিনি। কোমড়ের খাপ থেকে তলোয়ার বের করে গেলার্টের হৃৎপিণ্ড বরাবর তীক্ষ্ণ তলোয়ারটি ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মনিবের দিকে অবাক ও করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গেলার্ট।
ঠিক তখনই খুব কাছেই একটি বাচ্চার আওয়াজ শুনতে পেলেন রাজপুত্র লিওয়েলিন। চারপাশ খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেখেন বিছানাটির এক পাশে হাসিমুখে শুয়ে আছে তার সন্তান। আর তার পাশেই রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে বিশাল বড় এক নেকড়ে বাঘ। এরপরের ঘটনাটি অনুমান করা অসম্ভব নয়! মূহুর্তের মধ্যে রাজপুত্র বুঝতে পারলেন আসলে গেলার্টই নেকড়েটিকে মেরে তাঁর পুত্রের প্রাণ বাঁচিয়েছে। আর সেই ঘটনাটি জানাতেই সেসময় মনিবের কাছে ছুটে গিয়েছিল সে। সব বুঝতে পেরে রাজপুত্র গেলার্টের কাছে দৌঁড়ে এলেন। ততক্ষণে আর তার দেহে প্রাণ নেই। মূহুর্তের ভুলে নিজের সবথেকে প্রিয় কুকুরকে নিজের হাতেই হত্যা করে, রাজপুত্র শোকে প্রায় পাগলের মত হয়ে গেলেন। ভগ্ন হৃদয়ে রাজ্যের সবথেকে উঁচু জায়গায় সমাধিস্থ করলেন গেলার্টের মৃতদেহ। রাজ্য জুড়ে প্রচার করলেন গেলার্টের বীরত্বের কাহিনী। তারপর থেকে মানুষের মনে ও গল্প কথায় উজ্জ্বল ভাবে স্থান করে নিয়েছে গেলার্ট। তার কথা মনে করলেই এখনও চোখের জল ফেলেন বহু মানুষ।
Discussion about this post