সালটা ১৯৯২, তারিখ ডিসেম্বরের ৬। হুহু করে বইছে শীতল বাতাস, কিন্তু অযোধ্যায় তখন জনস্রোতে টগবগ করে ফুটছে চারিপাশ। হঠাৎ শোনা গেল একটা স্লোগান “এক ধাক্কা অর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো।” সকাল থেকেই উত্তেজনার আবহ। বিকেল ৪.৪৫ নাগাদ ভেঙে পড়ল প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরোনো একটি সৌধ। আর এই বছর অযোধ্যার ওই বিতর্কিত ভূমিতে ‘রামমন্দির’ মাথা তুলে দাঁড়ানোর পক্ষে রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। গত ৫ই আগস্ট বাবরির ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেখানেই স্থাপন হয়েছে রামমন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর। বছরের পর বছর আইনি লড়াই। দীর্ঘ লড়াই নিয়ে রাজনৈতিক জট, কাটিয়ে রায় হল ‘ওখানে মন্দিরই হবে’।
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’। গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন। অনেকেই বলেন, এ ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল।
এই বাবরির উত্তেজনা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশ জুড়েই। দাঙ্গা, অশান্তি, খুনোখুনি যেন রোজকার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাম-রহিমরা ক্রমেই হয়ে উঠল একে অপরের শত্রু। এর জেরে মুম্বই শহরেও শুরু হয়েছিল ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। মুম্বই শহর ছারখার হয়েছিল এই দাঙ্গার জেরে। দাঙ্গার বদলা হিসেবে ১৯৯৩ সালের ১২ই মার্চ মুম্বইয়ে ধারাবাহিক ভাবে ঘটানো হয় বিস্ফোরণ। নিহত হন ২৫৭ জন নিরীহ মানুষ, বয়ে যায় রক্তবন্যা।
তখন সদ্য অবসর নিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম নক্ষত্র সুনীল গাভাস্কার৷ হঠাৎ একদিন এক পৈশাচিক চিৎকারে কেঁপে উঠল ক্রিকেটারের ফ্ল্যাট বাড়ি। ক্রিকেটের রাজপুত্র এতদিন মাঠে জনতার উল্লাস শুনেছেন, কিন্তু এই বিভৎস শব্দ তার আগে শোনা হয়নি। গাভাস্কারের ফ্ল্যাটের সামনে তখন ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে কয়েক’শো লোক। একটি প্রাইভেট গাড়িকে লক্ষ্য করে চলছিল ইট পাথর বৃষ্টি। সবার হাতেই ধারালো অস্ত্র। গাড়ির ভিতরে ছিলেন এক তরুণ দম্পতি ও তাদের সন্তান। দাঙ্গাবাজদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন তারা। গাভাস্কার দেখলেন এরা থামার নয়। নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করেই ব্যারিকেডের মতো গাড়ি আগলে দাঁড়ালেন গাভাস্কার। সদ্য মাঠ থেকে ফেরা শান্ত শিষ্ট লোকটি যেন রুদ্ররূপ ধারণ করেছেন। দাঙ্গাবাজদের হটিয়ে তিনি বললেন “তোমরা যা করছ তা আমাকে দিয়ে শুরু করতে হবে, আমি জীবিত থাকতে আমি ওদের স্পর্শ করতে দেব না। তোমাদের হিম্মত থাকলে আমায় মারো, তোমরা কি মানুষ”। রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা নিমেষে শান্ত হয়েছিল সুনীলের একটি কথায়। কিন্তু সেদিন থামলেও আজও সেই দাঙ্গাবাজ মানসিকতা বহাল সারা দেশ জুড়েই।
Discussion about this post