বাংলা ‘গাজন’ শব্দটি গর্জন থেকে এসেছে। এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরকম নাম। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিয়ে হয়। এই বিয়েতে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন। বাঁকুড়া জেলা গাজন উৎসবে পিছিয়ে নেই। এখানকার একটি বিখ্যাত শিব গাজন হল বেলিয়াতোড় থানার অন্তর্গত রত্নেশ্বর শিবের গাজন। মন্দিরটি মাকরা পাথরের দেউল মন্দির। মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গটি বহু প্রাচীন এবং এটি অনাদি লিঙ্গ নামে পরিচিত। পাত্রসায়ের থানার অন্তর্গত হদল নারায়ণপুরের রাজারা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। স্থানীয় মানুষের দাবী এই গাজনের বয়স আনুমানিক ২০০ বছর। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে গাজনটি অনুষ্ঠিত হয়।
গাজনের ঢাকে কাঠি পরে পয়লা চৈত্র থেকে। পয়লা চৈত্র একবার ঢাক বাজে আর ১৫ চৈত্র থেকে দু’বার ঢাক বাজে। চৈত্রের ২১ তারিখ থেকেই মন্দিরে প্রতি সন্ধ্যায় রামায়ণ গান শুরু হয়। মূল গাজনের শুরু হয় ২৮ চৈত্র। এদিন হয় ‘মদ ভাঙ্গা’। মদ ভাঙ্গা অর্থাৎ এক সময় নতুন মৌচাকের মধু বের করা হত। সেই মধু দিয়ে রত্নেশ্বরের পাট চান করানো হত। তাকে বলা হত মধু ভঙ্গ। স্থানীয় মানুষের ভাষায় মধু ভঙ্গ থেকে মদ ভাঙ্গায় পরিবর্তন হয়েছে। এদিন ভক্তারা স্থানীয় মহিষাপুকুরে স্নান করে পৈতে পরে এবং বাবা রত্নেশ্বরের পুজো দেয়। এদিন নিজের গোত্র থেকে শিব গোত্রে আসে ভক্তারা। তারপর বাবার পাট অর্থাৎ লোহার পেরেক বিদ্ধ পাটাতন বার করা হয়।
গ্রামের কাছেই বীরবাঁধ পুকুরে ‘পাট চান’ করিয়ে গ্রাম ঘুরে পাট নিয়ে মন্দিরে ফেরে। সঙ্গে থাকে ঢাক, ঢোল, কাঁসি, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। পর দিন দিনগাজন। এদিন আশেপাশের গ্রাম থেকেও পাট আসে। যেমন হাট আশুরিয়া, বেলুট, মাঝিডাঙ্গা, রামপুর। পাটগুলি বিভিন্ন সময়ে নিয়ে আসে ভক্তারা। পুরো মন্দির ঘুরে পাটটি মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকানো হয়। তারপর পুজো করা হয়। গাজনের তৃতীয় দিন হল রাত গাজন। এদিন চৈত্র সংক্রান্তি। এদিন গাজনের মূল আকর্ষণ। এদিন রাতে বাবার পাট শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয় বীরবাঁধ পুকুরে স্নানের উদ্দেশ্যে।
ফেরার সময় শোভাযাত্রায় থাকে ধামাকন্যা। অর্থাৎ পাটের ওপর পাট ভক্ত শুয়ে থাকে। তার ওপর মন্দিরের পুরোহিত এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। থাকে ‘গাড়ি বাণ’। গরুর গাড়ির ওপরে আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে তাতে পা বেঁধে মাথার নীচে অগ্নিকুণ্ড রেখে ভক্তাকে দোলানো হয়। আর থাকে অগ্নি বাণ। ভক্তারা হাতে, জিভে যে বাণ ফোঁড়ে তার আগায় কাপড়ে পেঁচিয়ে, সর্ষের তেলে ভিজিয়ে আগুন দেয়। বাণ ফোড় সহ শোভাযাত্রা মন্দিরে ফিরতে ভোর হয়ে যায়। পরদিন সকালে অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন সকলের জন্য থাকে ‘লক্ষ্মণ ভোজ’। সেদিন মন্দিরেই ভক্তারা বাড়ির লোকেদের নিয়ে মাছ ভাত খায়। একটা চড়ুইভাতির পরিবেশ তৈরি হয়। গাজন উপলক্ষ্যে মেলা শুরু হয়ে যায় মদভাঙ্গার দু’দিন আগে থেকে। চলে পয়লা বৈশাখের পরের দু’দিন পর্যন্ত। শেষ দিন থাকে কলকাতার নামী দলের যাত্রাপালা।
Discussion about this post