এককালে দেবী কালিকার আরাধনা সীমাবদ্ধ ছিল তন্ত্র সাধক এবং ডাকাতদের ডেরা পর্যন্তই। ডাকাতির আগে মা কালীর কাছে পুজো নিবেদন এবং নরবলি নিয়ে নানান কিংবদন্তি এখনো প্রচলিত আছে বঙ্গে। তবে শুধু ডাকাত বা তান্ত্রিকরাই নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিপ্লবীদেরও মাঝে মাঝে দেখা গিয়েছে শক্তির আরাধনা করতে। যেমন মালদহে বিপ্লবীদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল দশমাথার মহাকালী পুজো।
এলোকেশী, নরমুন্ড ধারিণী উগ্ররূপের মাঝেও সাধারণের মনে জায়গা করে নিল দেবীর অভয়দাত্রী মাতৃরূপ। বঙ্গে দেবীর দক্ষিণাকালী রূপটি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করলেও তোড়ল তন্ত্র মতে দেবী কালিকা হলেন ‘অষ্টধা’। অর্থাৎ দেবীর আটটি রূপ। দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী। মালদহে এই মহাকালীরই আরাধনা এক কালে করতেন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখা একদল বিপ্লবী।
দেশে ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন মালদহে বিপ্লবীদের উদ্যোগে ইংরেজ বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্যায়াম সমিতি। গঙ্গাবাগ এলাকায় তাঁরাই শুরু করলেন মহাকালীর পুজো। দেবী দশভুজা এবং দশটি মাথা। দেবী প্রতিমার প্রথম দর্শনে মনে ভয় জন্মানো স্বাভাবিক। চিরাচরিত ভাবে দেখে আসা মা কালীর সঙ্গে শিবের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়না এখানে। বরং দেবীর পদযুগলের নীচে অবস্থান করছে অসুরের মুন্ড। দেবীর দশটি হাত, দশটি মাথা এবং দশটি পা; যা শত্রুর মনে ভীতি ও ধাঁধা জন্মানোর জন্য বাধ্যতামূলক। তন্ত্র মতে, দেবী সাধকের মনে তাঁর উগ্ররূপে প্রথমে ভয় সৃষ্টি করে এবং তারপরই সাধকের দেবীর আশীর্বাদ প্রাপ্তি ঘটে।
১৯৩০ সাল থেকে আজও মহাকালীর পুজো হয়ে আসছে ইংরেজবাজারে। ফুলবাড়ির মৃৎশিল্পী অষ্টম চৌধুরীর বাড়িতে প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। এবং দেবীকে সেখান থেকে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে আনা হয় মন্দিরে। দীপান্বিতা অমাবস্যায় আগের দিন অর্থাৎ চতুর্দশীর দুপুরেই করা হয় পুজো। দীর্ঘ ৯১ বছর ধরে এই নিয়ম। দেবী এখানে মহাকালী নামের চেয়ে দশ মাথার কালী নামেই বেশী পরিচিত সাধারণের মাঝে। মহাকালীর ভয়ঙ্কর রূপের মাঝেও বিপ্লবীরা শুরু করেছিলেন মাতৃ আরাধনা। তাঁর যতই উগ্ররূপ হোক না কেন তিনি যেন আপন মা। তাই শুধু তন্ত্র-মন্ত্র নয় মাতৃজ্ঞানে পুজো না করলে সব আয়োজনই যে বিফল।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – হাওড়া টাইমস
Discussion about this post