ছেলেটা একগুচ্ছ গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির হৃদগতির বেগ তখন বেশ খানিকটা বেড়েছে। চারিদিকে হালকা হাওয়া বইছে। তার সাথে রোমান্টিক একটা গান। ব্যাস ‘প্রপোজ ডে’র ষোলো কলা পূর্ণ তাই তো? প্রপোজের অভিধানিক অর্থ প্রস্তাব হলেও প্রপোজ বললেই একঝটকায় মাথায় খেলে যায় প্রেম নিবেদন। কিন্তু রূপোলি পর্দা বা গল্পপাতার পর আদালতের কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে প্রেম নিবেদনের কথা শুনেছেন কখনো? বাস্তবের কাঁটাতারে দাঁড়িয়ে এমন নজির বোধহয় আর কেউ রেখে যেতে পারেননি, যা একজন বিপ্লবী হয়ে তিনি রাখতে পেরেছিলেন। ইতিহাসের সেই কালজয়ী প্রপোজটার কথা শুনলে আপনার গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য।
বাতাসে তখন গোলাবারুদের গন্ধটা লেগে। অবিভক্ত বাংলার প্রতিটা মানুষ তখন গুমরে রয়েছে স্বাধীনতার লক্ষ্যে। ঘরের মেয়েরাও তখন বাইরে পা বাড়িয়েছে বন্দুক বারুদ হাতে। সেই অগ্নিদগ্ধ সময়েই একটি লম্বা, ছিপছিপে, সুন্দরী, মিষ্টি হাসির সাথে বলিষ্ঠ চাউনির মেয়ে কৈশোরের শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের অগ্নিকন্যা কল্পনা দত্ত। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বেথুন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পাঠরতা। কিন্তু গোপনে চলে স্বদেশী আখড়ায় যাতায়াত, চলে ডিনামাইট বানানোর প্রস্তুতি। ধীরে ধীরে যোগ দিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের আখড়ায়। সেই বিপ্লব দলেরই শান্ত স্বভাবের ডাকাবুকো ছেলে ফুটুদা ওরফে তারকেশ্বর দস্তিদার। বোমার শব্দেই হয়তো এতদিন চাপা পড়েছিল ওদের প্রেমের আভা।
১৯৩৩ সালের ১৯ মে। চলছে গোপন স্বদেশী মিটিং। খবর পেয়েই ব্যারিকেডসহ পুলিশি ঘেরাও, চলল গোলাবারুদের তান্ডব। মৃত বিপ্লবীদের দেহের ওপর দিয়েই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় কল্পনা তারকেশ্বরসহ আরও অনেককে। শুরু হয় বিচারপর্ব। বিচার চলাকালীনই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে বিপ্লবী তারকেশ্বর সেদিন বলে ওঠেন, “তোকে ভালো লাগে কল্পনা। যদি ফিরে আসি, আমার জন্য অপেক্ষা করবি?” অষ্টাদশী কল্পনা সেদিন থাকেন নিরুত্তর। এরপরই ফাঁসি হয় তারকেশ্বর দস্তিদারের। জেল হাজত খেটে ছাড়া পান কল্পনা দত্ত। পরে অন্য একজনের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে কল্পনা দেবীর জন্য। কিন্তু সেদিন আর চুপ থাকেননি তিনি। শক্ত গলায় জানান, “আমি যে ফুটুদাকে কথা দিয়েছি। এ কাজ তাই অসম্ভব।”
Discussion about this post