বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অধ্যায়টা আজও বেশিরভাগটাই যে মানুষটার ওপর ভর করে বয়ে চলেছে তিনি হলেন আমাদের প্রাণের ঠাকুর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথা শুনলেই ভাবতে ইচ্ছে করে তিনি আমাদের অন্তরের, খুব আপন কেউ একজন। জীবনে তিনি সাহিত্যসৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলেও এমন কোনো পরিসর ছিল না যা তাঁকে ছুঁতে পারেনি। একবার তিনি লেখিকা রানী চন্দকে বলেছিলেন যে সবরকম কলার মত রন্ধনকলাতেও নাকি তার পারদর্শিতা ছিল। এ ছিল একেবারে খাঁটি কথা। বরাবরই ঠাকুরবাড়িতে তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর হাতের রান্নার জাদু ছিল জনপ্রিয়। এমন রন্ধন পটিয়সী স্ত্রীকেও কবিগুরু মাঝে মাঝে বিভিন্নরকম রান্না শিখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন। তবে আজ আমরা তাঁর রন্ধনশিল্পী স্বত্তার সাথে নয়, পরিচয় করব তাঁর ভোজনরসিক চিত্তের সঙ্গে।
ঠাকুর বাড়ির সব সদস্যই ছিলেন বেশ খাদ্যরসিক। তাই রবীন্দ্রনাথই বা বাদ যাবেন কেন! তাঁর সময় ঠাকুরবাড়িতে ‘পাঁঠার বাংলা’ নামের একটি পদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। কালের নিয়মে এই পদের অবলুপ্তি ঘটলেও কবিগুরুর খাদ্যতালিকায় ছিল এই পাঁঠার বাংলা। ১৯৪১ সালে কালিম্পংয়ে গিয়ে কবিগুরু অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই এই পদ জায়গা করে নেয় তাঁর খাদ্যাভ্যাসে। তবে সুস্থ থাকাকালীন তিনি খুব পছন্দ করতেন আনারস দিয়ে তৈরি রোস্টেড পাঁঠার মাংস। ঠাকুর বাড়িতে খাদ্য নিয়ে নানারকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলত বরাবরই। তাই বিভিন্নরকম পদ সৃষ্টিতে ঠাকুর বাড়ি ছিল একশোয় একশো।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝেও একথা মানতেই হবে তিনি ছিলেন খুবই স্বাস্থ্য সচেতন। তাই গুণ রয়েছে এমন যেকোনো খাবার খেতে কবি ছিলেন সদাই প্রস্তুত। জানা যায় একবার তাঁর এক বিদেশি বন্ধু তাঁকে ডিমের গুণাগুণ নিয়ে বলেছিলেন। রানী চন্দের লেখা থেকে জানা যায় এরপর থেকে কবি কাঁচা ডিম ভেঙে তাতে একটু নুন-গোলমরিচ মিশিয়ে চুমুক দিয়ে খেয়েছিলেন। তারপর এক আয়ুর্বেদজ্ঞ তাঁকে নিম পাতার রস খেতে বললে তিনি সেই কথা মেনে রোজ সকালে তা খেতে শুরু করেছিলেন। এসব খেলেও দেশি খাবারের মধ্যে তাঁর পছন্দের খাবারগুলো ছিল চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি এবং কাঁচা ইলিশের ঝোল।
কবির খামখেয়ালিপোনা ছিল ষোলো আনা। মৃণালিনী দেবীও অবশ্য সেই খামখেয়ালিপনাকে প্রশ্রয় দিতেন হাসি মুখে। এই যেমন মাঝে মাঝে তিনি রাতদুপুরে স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে কিছু রান্না করে খাওয়াতে বলতেন। আর তিনিও সেই আবদার মেটাতেন। ছোটো ছোটো এমন অনেক ঘটনার মত তিনি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তেও লিখেছিলেন ‘’আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি, সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে।” হয়তো এমনভাবেই তিনি তাঁর খাদ্যরসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
Discussion about this post