দুর্গা মানেই ফর্সা মুখ, টিকালো নাক আর টানাটানা চোখ। সেই ছোট্ট থেকে এভাবেই আমরা চিনেছি শরতের মহিষাসুরমর্দিনীরূপী নবদুর্গাকে। কিন্তু ঊমা যদি অপরাজিতার ওই নীল রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে চান তখন কি হবে? হ্যাঁ ঠিক এমনই এক স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বরিশালের বনেদি ঘোষ রায়পরিবারের কর্তামশাই। মায়ের ইচ্ছেতেই তাই রায় পরিবারের কাছে ঊমা হয়ে ওঠেন সেদিন আদরের ‘নীল দুর্গা’। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গের সেই নীল দুর্গাই নলিনী মোহন রায়ের হাত ধরে আস্তানা নিলেন কলকাতার প্রতাপদিত্য প্লেসের বাড়িতে। জাঁকজমকে বাংলায় শুরু হয়ে গেল নীল দুর্গার আরাধনা। এতগুলো বছর ধরে ঢাক কাঁসর বাজিয়েই ঘোষ রায় পরিবারে শরতের আসরে জমে ওঠে এই নীলদুর্গার পুজোতেই।
শ্যামার মতো গায়ের রঙ হলেও নীল দুর্গা আর ঊমার তেমন কোনো তফাৎ চোখে পড়েনা। ডাঁয়ে সরস্বতী কার্তিক আর বাঁয়ে লক্ষ্মী গণেশ নিয়েই শোলা কিংবা ডাকের সাজে সেজে ওঠেন মা। পঞ্চমীতে কালিঘাটের পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা এনে চলে বেলবরণের প্রস্তুতি। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বাড়ির মেয়েরা লালপাড় সাদা শাড়ী পরে শুরু করে বোধন আর অস্ত্রদান পর্ব। সপ্তমীর সকালে বাড়ির কর্তার হাতে কলাবৌ স্নান আর অষ্টমীতে ১০৮ মাটির প্রদীপ ও ১০৮ টি পদ্ম যোগে সন্ধিপুজো। নবমীর পুজোতে আবার বাড়ির বড় জামাইয়ের মন্ত্রপাঠ দিয়ে বসে যজ্ঞ। তবে সবথেকে মজার দিন হল দশমীর বিসর্জন। পুজোর শেষ ঘোষণাকে ঘিরে খারাপ লাগা থাকলেও দর্পন বিসর্জনের পর মায়ের পা জলে ভেসে ওঠা দেখতে পাওয়া নিয়ে চলে ইয়ার্কি ঠাট্টা। দেখতে পেলে পুণ্যবান আর না পেলে সে পাপী।
পুজোর মধ্যে তেমন আলাদারকম বিশেষত্ব না পাওয়া গেলেও মায়ের ভোগের মধ্যে রয়েছে বেশ নতুনত্বের ছোঁয়া। প্রত্যেকদিন শাক, কাঁচা সবজি, চাল, বিভিন্ন ধরনের ডাল, সরষের তেল, নুন, লেবু, লঙ্কা, ফল রাখা হয় হয় মায়ের কাছে। এমনকি কাঁচা রুই মাছ নুন হলুদ মাখিয়েও নিবেদন করা হয় মাকে। না, কোনো রান্না করা ভোগ অবশ্য চড়ে না, তবে বাড়ির বানানো নাড়ুটা প্রতিদিন মায়ের চাই-ই চাই। অষ্টমীতে লুচি, সুজি আর পায়েসের ভোগ সাজানো হয় মন্ডপ জুড়ে। এভাবেই আদরে আপ্যায়নে নীলদুর্গাকে প্রতিবছর তুষ্ট করে রাখেন পরিবারের লোকেরা। নলিনী মোহন রায়ের মৃত্যুর পর নীল দুর্গার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নেন ওনারই আত্মীয় সুরুচি বালা ঘোষ রায়। আরাধ্য দেবীকে আনেন ৪৮, সাদার্ণ এভিনিউর বাড়িতে। আর বেশি দেরি নেই। ক’দিন বাদেই বাঙালির ঘরে মা ঊমার আগমন ঘটলে বলে। ঘোষ রায়বাড়ির বনেদিয়ানায় সেদিন মিশবে আবার নীলদুর্গা পূজার সেই ঐতিহ্যময় আয়োজন।
সম্পাদনায় অনন্যা করণ
Discussion about this post