“আ লো বান্দিনীর ঘরের চান্দিনী… মুখ সামলাইয়া কথা ক, বুক সামলাইয়া ঘরে যা।” — অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের এই সংলাপ যেন আদ্যন্ত তুলে ধরে মালো নারীর সাহসী ঝংকার, তার আবেগ আর অস্তিত্বের সারল্য। বাংলাদেশের খুলনা আর নড়াইলের মাত্র দশ-বারোটি গ্রামে টিকে থাকা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার এই অনন্য প্রকরণ আজ এক বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। এই প্রাচীন পদ্ধতিতে শুধু মালো সম্প্রদায়ই পারদর্শী। কৈবর্ত, তিয়র এবং মালো—এই তিন জাতিকে ইতিহাস ভাটি বাংলার আদি বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মালোরাই এই জাতিদের মধ্যে সেরা নৌচালক, সাহসী যোদ্ধা, আর গভীর শিল্পবোধসম্পন্ন এক জনগোষ্ঠী। বাংলার মালকোঁচা বাঁধার ধারা হোক বা কৃষ্ণকীর্তনের খোল বাজানোর চল, এই জাতির সংস্কৃতিতেই তার উৎস।
নড়াইলের চিত্রা নদী, প্রাক-বর্ষা ও শীতকাল মালোদের ভোঁদড় নিয়ে মাছ ধরার মুখ্য ক্ষেত্র। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নিছক প্রশিক্ষণ নয়, বরং সাতপুরুষের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যার ফল, যা দক্ষিণের করমন্ডল উপকূল থেকে একদা চলে এসেছিল এই গাঙ্গেয় বঙ্গদেশে। ভোঁদড়রা যেন মালোদের পরিবারের অংশ, আর তাদের সঙ্গে মাছ ধরার কর্মযজ্ঞ এক আন্তরিক সহাবস্থান। মালোদের বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা, যা সুন্দরবনের দুবলার চরে আয়োজন করা হয়। যদিও আজ তা ব্রাহ্মণ্য-রীতিনীতিতে আবদ্ধ, এক সময় এই উৎসব ছিল মালো-ঝালোদের, অর্থাৎ জাল ফেলা মৎসজীবীদের একাধিপত্য। ‘ঝালো’ শব্দটি এসেছে ‘জালো’ থেকে—এরা সেই মানুষ, যারা মৎসজীবিতার মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত না হয়ে আদি পেশাতেই টিকে থেকেছে।

মালোদের ধর্মীয় পরিচিতি বহু স্তরবিশিষ্ট। আজকের হিন্দু রাসমেলা আর তার নৈষ্ঠিকতা এককালে ছিল জলপূজক টোটেম বিশ্বাসের এক উৎসব। গঙ্গা ছিল তাদের আরাধ্য, দেবতা নয়, বরং টোটেম। এইসব টোটেম উপাসকগণ বৌদ্ধ তান্ত্রিক আদর্শেও আকৃষ্ট হয়েছিল। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বৈষ্ণব ঘরানায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া চণ্ডাল-মালোদের আত্মপরিচয় পরিবর্তন করে দিয়েছিল। কিন্তু মূল বিশ্বাসে তারা প্রকৃতি-পূজারিতে পরিণত হয়ে উঠেছিল। রাসপূর্ণিমার রাতে নারীদের হাতে রাখা ডাবে গোপন মনস্কামনা আর ঢেউয়ের হাতে তাদের অর্পণ—এ এক গূঢ় আচার, এক গভীর বিশ্বাস যা অক্ষত থেকে যায় সভ্যতার ছোঁয়ায়ও।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর উপন্যাসে এই জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব আর শ্রেণিচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কৃষ্ণ না শিব, বৈষ্ণব না তান্ত্রিক, মালোদের আত্ম-সন্ধান কখনও তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, কখনও আত্মসম্মান আর কখনও প্রহসনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। কিশোরচাঁদের নিজের পরিচয়ে ‘মূল্যব্রাহ্মণ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ যেন একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধও বটে। প্রান্তিক হলেও মালো সমাজ তার শিকড় জানে, ইতিহাস জানে, আর জানে প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার শিল্প—হোক তা ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা বা জীবনের ঢেউয়ে ভেসে চলা।
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – সৌভিক রাতুল বসু
Discussion about this post