আজ আমরা চাইলেই আমাদের পাঠানো তথ্য নিমেষে পৌঁছে যেতে পারে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু আগে বিষয়টা এতো সহজ ছিল না। কোনো তথ্য জানতে বা জানাতে বা কারুর খোঁজ নিতে মানুষ একে অপরকে লিখতেন চিঠি। সেই চিঠি নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে তার কাছ থেকে আবার উত্তর পেতে চলে যেত অনেকটা সময়। এই সমস্যাকে অনেকাংশে দূর করেছিল টেলিগ্রাফের আবিষ্কার। টেলিগ্রাফ হল আসলে দূর-দূরান্তে লিখিত বার্তা প্রেরণের এক বিশেষ পদ্ধতি। যাতে মূল লিখিত পত্রকে না পাঠিয়ে তার বা বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে চিঠিতে লেখা বার্তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেওয়া যায়। আমাদের আধুনিক সময়ে ফ্যাক্স, ই-মেল ইত্যাদিও সামগ্রিকভাবে টেলিগ্রাফেরই অন্তর্গত। ১৮৩৬ সালে আমেরিকান আবিষ্কারক ডেভিড আল্টার প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেছিলেন। তবে আজ আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু অল্টার সাহেব নন, বরং অন্য কেউ। আমরা জানি বাঙালি তার দক্ষতা ও প্রতিভার জোড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ছাপ রেখে থাকেন। আজ তেমনই এক বাঙালির কথা বলব।
উনবিংশ শতকে ভারতে ইংরেজদের হাত ধরেই টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার জন্ম হয়। আর সেই টেলিগ্রাফ বিভাগের প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালি কর্মী হিসাবে শিবচন্দ্র নন্দী প্রথম টেলিগ্রাফ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ১৮৪৬ সালে উইলিয়াম ব্রুক ও’শাউগনেসির অধীনে টাঁকশালে কাজ করার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করেন। পরবর্তীকালে ও’শাউগনেসি যখন ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফিক লাইন তৈরীর কাজ শুরু করেন তখন শিবচন্দ্র নন্দীকে তাঁর সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করেন। এরপর লাইন স্থাপনের কাজ শেষ হলে, লর্ড ডালহৌসিকে তা দেখার জন্য ডায়মন্ড হারবার থেকে কলকাতায় বার্তা পাঠান শিবচন্দ্র নন্দী। এই বার্তা প্রেরণকে ঐতিহাসিক বার্তা প্রেরণ বললে কোনো অত্যুক্তি হবেনা। কারণ ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফিক বার্তা প্রেরণ হয়েছিল এই বাঙালির হাত ধরেই। পরবর্তীকালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিগন্যাল প্রেরণকারী কর্মীদের ইন্সপেক্টরের পদ তিনি পান। ১৮৬৬ সালে তিনি সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পদে উন্নীত হন। এছাড়া তাঁর অবসর নেওয়ার পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন।
শিবচন্দ্র নন্দী যে কেবল প্রথম বার্তা প্রেরণ করেন বা বিভিন্ন উচ্চপদে ছিলেন তাই নয়। তাঁর কৃতিত্বের ঝুলিতে আছে আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে অন্যতম হল স্বল্প খরচে লাইন স্থাপন। যেমন তিনি মাছ ধরার নৌকার সাহায্যে অল্প খরচায় পদ্মা নদীর নীচ দিয়ে সাত মাইলের কেবিল বসান। এছাড়া তিনি একবার ব্যারাকপুর থেকে এলাহাবাদ, বেনারাস – মির্জাপুর থেকে শীওনি এবং কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত দীর্ঘ ৯০০ মাইল টেলিগ্রাফিক সংযোগ স্থাপনের দায়িত্ব পান। তখন এই দীর্ঘ পথে তার সংযোগের জন্য তিনি তাল গাছকে খুঁটি হিসাবে ব্যাবহার করেন। তাঁর এই বুদ্ধিতেই পরবর্তীতে টেলিগ্রাফিক তার সংযোগের ক্ষেত্রে তাল গাছকে খুঁটি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। টেলিগ্রাফির কাজ ছাড়াও ১৮৪৯-৫০ সালে তিনি বাংলার এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষও ছিলেন।
Discussion about this post