আকাশে ওড়া তো দূরের কথা, জন্মের আগেই আমাদের দেশে মেয়েদের ডানা কেটে দেওয়া হয়। আজও পাঁচ লক্ষেরও বেশি কন্যা সন্তান নিখোঁজ। আজও বহুজায়গায় জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কন্যাসন্তান পরিত্যক্ত। আজও জন্মের আগেই বহু জায়গায় লিঙ্গ পরিচয় জেনে গর্ভেই মেরে ফেলা হয় কন্যাভ্রুণ। আজও এই কন্যাভ্রুণ হত্যার পরিমাণ ভারতে কম নয়। অথচ এই ভারতের আকাশেই ডানা মেলে উড়ে ঘুরে বেড়াতে পেরেছিলেন ভারতেরই এক কন্যা। তিনি সরলা ঠকরাল। ভারতের প্রথম মহিলা পাইলট।
সরলা ঠকরালের স্বপ্ন ছিল উচ্চতাকে ছোঁয়ার। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতেও দেরি হয়নি। তিনি এমন একটি স্বপ্ন পূরণ করলেন, যা ভারতের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। ১৯১৪ সালে অবিভক্ত ভারতে তাঁর জন্ম। দিল্লিতে জন্ম হলেও পরে তিনি বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে চলে যান। সেখানে তাঁর আলাপ হয় পাইলট পি ডি শর্মার সঙ্গে। তাঁকেই বিয়ে করেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। স্বামীর পরিবারে, স্বামীসহ পরিবারের নয়জন মানুষ ছিলেন পাইলট। সম্ভবত সেই জায়গা থেকেই সরলা আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। সেই জন্যই, চার বছরের মেয়ের ষোল-সতেরো বছরের মা, নির্দ্বিধায় আকাশে ওড়ার প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছিলেন।
বিশ বা ত্রিশের দশকে ভারতীয় সমাজে কোনো নারী, পুরুষের পাশে বসে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেবেন, এ কথা ভাবাও আশ্চর্যের বিষয় ছিল। কিন্তু সরলা ঠকরালের পরিবার সরলার পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভাগ্যিস, সরলা কে ঘোমটা দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়নি! হলে, ভারতীয় মেয়ের আকাশে ওড়ার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই বেশ কিছু বছর পিছিয়ে যেত। মাত্র ২১ বছর বয়সে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের পরে বিমানের পাইলট হিসাবে লাইসেন্স অর্জন করেছিলেন সরলা। প্রাথমিক লাইসেন্স পাওয়ার পরে তিনি লাহোর ফ্লাইং ক্লাবের বিমান চালাতেন। তাঁর বিমানের যাতায়াত ছিল করাচি এবং লাহোরের মধ্যে। প্রায় ১০০০ ঘণ্টারও বেশি বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল সরলা ঠকরালের।
সরলার স্বামী ক্যাপ্টেন শর্মা ১৯৩৯ সালে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কিছু সময়ের পরেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেইসময় সিভিল পাইলটদের প্রশিক্ষণ স্থগিত ছিল। ফলে, চেষ্টা ও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরলা ট্রেনিং চালিয়ে যেতে পারেননি। জীবিকা অর্জনের তাগিদে, ঠকরাল মেয়ো স্কুল অব আর্টে ভর্তি হন। তিনি বেঙ্গল স্কুল অফ পেইন্টিংয়ের উপর প্রশিক্ষণ নেন। পরে তিনি একজন সফল মহিলা ব্যবসায়ী এবং চিত্রকর হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৮ সালে মৃত্যূ হয় তাঁর। তাঁর মৃত্যু হলেও তিনি আজও অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। ভারতের প্রথম মহিলা পাইলট হিসেবে, যিনি শাড়ি পরে বিমান চালিয়ে রাজত্ব করে বেড়িয়েছেন আকাশময়।
Discussion about this post