রামায়ণ মহাভারতের সময় থেকে নবাবী সাম্রাজ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেই একটা শব্দের প্রয়োগ বারংবার উচ্চারিত হতে শোনা যায় তা হলো ‘ঘর শত্রু’। সে রামায়ণের বিভীষণ হোক কিংবা ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশের তাঁবেদারি করা বাঙালি। এদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন মহারাজা নন্দকুমার। যিনি ব্রিটিশদের কাছে নিজের মহানুভবতা প্রমাণ করেছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এমনকি এ কাজের জন্য ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে পুরস্কৃত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার শেষ পরিণতি বড়ই ভয়ঙ্কর। ব্রিটিশ আদালতে ফাঁসি হয়ে তাঁর, আর তার সঙ্গেই সৃষ্টি হয় ভারতবর্ষে এক ইতিহাস।
দিনটা ছিল ৫ আগস্ট ১৭৭৫। ফাঁসির আসামি আর কেউ নন মহারাজা নন্দকুমার। সে সময় প্রকাশ্য রাস্তায় জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়ার রীতি ছিল যাতে ফাঁসির আসামীর চরম পরিণতি দেখে যে কেউ অপরাধ করতে ভয় পায়। ফাঁসির জন্য খোঁড়া হয় এক বিশাল কূপ। যদিও নন্দকুমারের মামলাটি ছিল অতি সাধারণ, নিতান্তই ছোট একটি জালিয়াতির মামলা। শোনা যায় নন্দকুমারের এই পরিণতি পেছনে ছিল বড় ষড়যন্ত্র। নন্দকুমার দেশীয় রাজ শক্তিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। আর তাতেই ইংরেজদের আঁতে ঘা লাগে। তাই মিথ্যা জালিয়াতির মামলার সূত্র ধরে তাকে সমূলে বিনাশ করার পন্থা অবলম্বন করা হয়।
এদেশে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এর আমলে কোম্পানির একজন সামান্য কর্মচারী হয়ে কর্মরত ছিলেন নন্দকুমার। তাঁর দায়িত্ব ছিল বর্তমানের নদীয়া, হুগলি, বর্ধমানের খাজনা আদায় করা। সে সময় তিনি আর্থিক ক্ষেত্রে বড় গন্ডগোল দেখতে পান। ১৭৬৩ সালে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমান সহ কোম্পানির কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। এই ঘটনায় কোম্পানি হেস্টিংসকে সরিয়ে তার বদলে নন্দকুমারকে কালেক্টর হিসেবে মনোনীত করে। ফলে হেস্টিংসের সব রাগ গিয়ে পড়ে নন্দকুমারের ওপর। কিন্তু নন্দকুমার লর্ড ক্লাইভের স্নেহের পাত্র হওয়ায় হেস্টিংস সে সময় তার কোন ক্ষতি করতে পারেননি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে নন্দকুমার গোপনপত্র বিনিময় করতেন। আর এই কথা জানতে পেরে লর্ড লাইফের সঙ্গে নন্দকুমারের তিক্ততার সৃষ্টি হয়।
তবে এই ঘটনার পাশাপাশি আরও একটা ঘটনা বলা দরকার। সে সময় নন্দকুমারের সঙ্গে বোলাকি দাস নামক এক জহুরির জহরতের কারবার ছিল। নবাব মীর কাশিমের আমলে একবার নন্দকুমার তাকে একটি মুক্তার হার, একটি কলকা, একটি শিরপেচ এবং চারটি হীরার আঙটি বিক্রি করতে দেন। যুদ্ধের সময় বেলাকি দাসের থেকে তার নিজের জিনিসপত্র সহ নন্দকুমারের জিনিসপত্রও লুঠ হয়ে যায়। ফলতঃ বােলাকিদাস নন্দকুমারকে ৪ হাজার ২১ টাকা পরিশােধ করবেন বলে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও স্থির হয় ৪ শতাংশ হারে সুদ দেবেন। পরবর্তীকালে বংশানুক্রমে সে টাকা পরিশোধও করেন বোলাকি দাসের পরিবার। কিন্তু বোলাকি দাসের আত্মীয় গঙ্গাবিষ্ণু সেই টাকার হিসাব নিয়ে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। যদিও নন্দকুমার তখন তার কাছে থাকা চুক্তিপত্রের জোরে সে যাত্রায় বেঁচে যান।
১৭৭৩ সালে গভর্নর জেনারেল হিসেবে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন ঘটে হেস্টিংসের। একেই পুরনো রাগ তার ওপর প্রতিশোধের জ্বালা মেটানোর এমন সুযোগ হাতে পেয়ে তা হাতছাড়া করলেন না হেস্টিংস। হেস্টিংসের পরামর্শে গঙ্গাবিষ্ণু হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন এবং বোলাকি দাসের চুক্তিপত্রটি জাল বলে দাবি করেন। ১৭৭৫ সালের ১২ মে শুরু হলো আদালতের কর্মকাণ্ড। বিচারপতির আসনে তখন হেস্টিংসের পরম বন্ধু এলিজা ইম্পে। এক প্রকার ক্ষমতা আর বন্ধুত্বের জোরেই জিতে গেলেন হেস্টিংস। ১৬ জুন ফাঁসির রায় বেরোয় ও ৫ আগস্ট ফাঁসির দিন স্থির হয়। যদিও জল এরপরেও অনেকদূর গড়িয়েছিল। একদিকে যেমন জালিয়াতির কারণে ভারতবর্ষের আইন ফাঁসি দেওয়ার বিরুদ্ধ ছিল তেমনি অন্যদিকে ভারতবর্ষের আইনে কোনো ব্রাহ্মণকে ফাঁসি দেওয়া নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ ছিল।
যদিও সকল ঘটনা বাস্তবে প্রকাশ্যে আসার আগেই ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয় নন্দকুমারকে। আর ইতিহাসের পাতায় ভারতবর্ষের প্রথম ফাঁসি হওয়া ব্যক্তি রূপে চিরজীবনের মতো স্বাক্ষরিত হয়ে যায় মহারাজা নন্দকুমারের নাম।
চিত্র ঋণ – নেক্সট ফিউচার ম্যাগাজিন
Discussion about this post