চেনা শহরের ইতিউতিতে রয়েছে হাজার অজানা রহস্যের ভিড়। আর সেই রহস্যের শিকড় সন্ধানেই উঠে আসে এমন কিছু সুপ্রাচীন তথ্য,যা আজও আমাদের অবাক করে তোলে। এমনই এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কালীমন্দির হল বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটের ‘ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি’। এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এক বিধর্মী বিদেশির হিন্দু বাঙালি হয়ে ওঠার গল্প। রূপোলী পর্দায় চাপদাড়ির সেই এন্টনি সাহেবকে মনে আছে তো ? হ্যাঁ, সে আমাদের চির পরিচিত মুখ উত্তমকুমার। কিন্তু বাস্তবের ফিরিঙ্গি সাহেবকে কতটুকুইবা চিনি ? আর কেনইবা এই মন্দিরের নামের মধ্যে ‘ফিরিঙ্গি’র অনুপ্রবেশ ঘটল? সেই কাহিনীগুলো জানতে আমাদের হাঁটা দিতে হবে, বহুবছর আগের কলকাতা শহরটার ইতিহাসে।
সারা ভারতে সেইহময় তীব্র ভক্তি আন্দোলনের ডাক। বাংলাসহ পূর্ব ভারতে তখন আদ্যাশক্তির আরাধনা।’শাক্ত’ সম্প্রদায়ের সংখ্যাই ছড়িয়ে পড়ছিল এই অঞ্চল জুড়ে।একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়,৫১টি শক্তিপীঠের ১৩ টাই বাংলায় স্থাপিত।গঙ্গার প্রবাহ তখন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ওপর দিয়ে।আর তারপাশেই এক শুনশান ঘন জঙ্গল।গা ছমছমে এই পরিবেশের মধ্যেই ছিল মহাশ্মশানের অবস্থান।একটা ছোট্ট চালাঘরে শিবলিঙ্গের সাথে অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন কালিকা বা শ্মশানকালী।যদিও দেবীর নাম ছিল ‘মা সিদ্ধেশ্বরী’। মন্দির ফলক অনুসারে,৯০৫ বঙ্গাব্দেই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা।১৮২০ থেকে ১৮৮৫ শ্রীমন্ত পন্ডিতই ছিলেন প্রধান পুরোহিত। কিন্তু নিঃসন্তান হওয়ার কারণে পরে মাত্র ৬০ টাকায় মন্দির হস্তান্তর হয় শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।
সময় ঘুরল।শুরু হল ফিরিঙ্গি অর্থাৎ বিদেশী জাতির আধিপত্য পর্ব। কোলকাতার ভোল পাল্টাতে শুরু করেছে।চারিদিকে জঙ্গল সাফাই হয়ে তীরবেগে ছুটে চলছে যানবাহন।তখনই বাংলার চন্দননগরে আগমন ঘটল খ্রীষ্টান কবিয়াল এন্টনি সাহেবের।জাতিতে পর্তুগিজ।সমাজের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য উপেক্ষা করে, অল্পবয়স্কা এক হিন্দু বিধবার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।তারপর চলে শ্যামার পরম সাধনা।নামী কবিয়ালদের হারিয়ে চলে বিজয় প্রাপ্তি।একজন বিদেশী হয়েও অল্পদিনেই বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। হিন্দুধর্মের এক একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে ওঠা,তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে।এই কালীবাড়ির পাশেই ছিল তাঁর মামাবাড়ি।সেই সুবাদে প্রায়ই এই মন্দিরে এসে নিজেকে ভক্তিরসে উৎসর্গ করে গান ধরতেন ফিরিঙ্গি সাহেব।তাই এই ” শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালিমাতা ঠাকুরানী” মন্দিরটি ধীরে ধীরে “ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি” হিসেবে পরিচিতি পায়।
পঞ্চমুন্ডির আসনে অধীষ্ঠাত্রী দেবীর এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মেলবন্ধন। তাই এই মন্দির চত্বরে বিভিন্ন ধর্মের দর্শনার্থীর সমাগম হয় প্রতি বছর। কালীপুজোয় চলে লাইন করে পুজো দেওয়া। যদিও এবছর করোনা পরিস্থিতিতে দেখা যাবে না সেই চেনা ছবি। তবে যুগ যুগ ধরে ভক্তের বিশ্বাসে ও ইতিহাসের ছোঁয়ায় এই মন্দিরটি এক ঐতিহ্যবাহী দর্শনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
Discussion about this post