উপন্যাস থেকে কবিতা, সিনেমা থেকে ফটোগ্রাফি সব ক্ষেত্রেই যে পরিবারের পারদর্শিতার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে তারা হলেন রায় চৌধুরী পরিবার। অর্থাৎ উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর পরিবার। ১৮৬৩ সালের আজকের দিনেই পূর্ব বঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারে কামদা রঞ্জন রায়ের জন্ম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে নিঃসন্তান জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরী তাকে দত্তক নিলে তার নতুন নামকরণ করা হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। শিশু সাহিত্যিক থেকে চিত্রকর কিংবা ঔপন্যাসিক থেকে বেহালাবাদক ও সুরকার এরকম বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে তিনি বেঁচে আছেন আপামর জনসাধারণের মধ্যে। কিন্তু আজ তার জন্মদিনে তার জীবনের এমন একটি দিক নিয়ে আলোচনা করবো যা হয়তো বহু আলোচিত নয়।
সালটা ১৮৯৫, ভারতের মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে এক নব দিগন্তের উন্মোচন হলো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাত ধরে। যাকে ইতিহাস ভারতের মুদ্রণ শিল্পের একটা যুগের অবসানও বলে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে বলা হয় ‘ভারতীয় মুদ্রণ শিল্পের জনক’। শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোরের নতুন উপন্যাস ছেলেদের রামায়ণ তখন সদ্য ছাপা হয়েছে সিটি বুক সোসাইটি’ নামক এক মুদ্রণ সংস্থার তরফে। কিন্তু সেই বইয়ের গুণগত মান ও মুদ্রণের অবস্থা দেখে তিনি বেশ মর্মাহত হন। তিনি ঠিক করলেন নিজে বই ছাপবেন। তার জন্য তিনি শুরু করলেন ফটো ও মুদ্রণ শিল্প নিয়ে গবেষণা। সে সময় ইউরোপীয় দেশ গলিতে ‘হাফটোন’ নামের বই ছাপাবার পদ্ধতিতে কাজ শুরু হয়। তিনি শুরু করলেন সেই হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা। তার বাড়ির স্নান ঘর বদলে গেল ডার্ক রুমে।
৩৮/১ নং শিবনারায়ণ দাস লেনের ভাড়া বাড়িতে তিনি খুললেন তার সাধের ছাপাখানা ‘ইউ রে এন্ড সন্স কোম্পানি’। সে সময় গোটা ভারত উপমহাদেশ তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে এরকম উন্নত মানের ছাপাখানা দ্বিতীয়টি ছিল না। তিনি দেখলেন কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে খোদাই করে ছাপলে সেই ছাপা অনেক উন্নত মানের হয়। অন্ধকার ঘরে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ লক্ষ্য করে তিনি হাফটোন ব্লক তৈরির সূত্রের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেন স্ক্রিন তৈরির নকশা। এই অসামান্য কৃতিত্বের পর তিনি তৈরী করলেন ‘হাফটোন ব্লক’। (ফটোগ্রাফকে বইপত্র ছাপার উপযুক্ত করে ব্লগ তৈরীর প্রযুক্তিকেই বলে হাফটোন)। উন্নত মানের মুদ্রণ ও অলংকারের জন্য তিনি নিজের খরচে ইংল্যান্ড থেকে আনালেন উন্নত মানের ছাপার কালি, কেমিক্যাল, যন্ত্রপাতি ও আরও নানাবিধ প্রয়োজনীয় সামগ্রী। প্রসেস শিল্পে উপেন্দ্রকিশোর প্রথম এবং শেষ ভারতীয় যিনি মৌলিক অবদানের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। (প্রসেস ক্যামেরা নিয়ে মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে ছবির নেগেটিভ আরো উৎকৃষ্টমানের করে বহুসংখ্যক ছবিকে একইসঙ্গে বইতে ছাপাবার পদ্ধতি হল প্রসেস পদ্ধতি)।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হাতে ধরেই ভারতবাসী পেল প্রথম রঙিন বই ছাপার দেশীয় পদ্ধতি। তিনি স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়াফর্ম সিস্টেম প্রভৃতি ব্যবহার করে সে যুগেও রংবেরঙের ছবি ছাপেন। পরবর্তীকালে এই ছাপাখানা থেকেই ছাপা হতো ছেলেদের মহাভারত ,টুনটুনির গল্প, গুপী গাইন বাঘা বাইন, সন্দেশ পত্রিকা সহ আরও বিভিন্ন বই। এমনকি তার পদ্ধতি অনুসরণ করেই ব্রিটেন বাণিজ্যিক ভাবে ‘প্রিন্ট প্রসেস’ ও ‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টিং মেশিন’ তৈরি করে। পরবর্তীকালে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে সম্মান জানিয়ে এই মেশিন দুটির নামকরণ করা হয় ‘রে প্রিন্ট প্রসেস মেশিন’ ও ‘রে স্ক্রীন অ্যাডজাস্টিং মেশিন’। সে সময়কার বিখ্যাত প্রিন্টিং জার্নাল ‘পেনরস অ্যানুয়াল’-এও প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়ে লেখা তার একাধিক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। এই প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনার জন্য তিনি তার সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায়কেও বিদেশে পাঠান। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবর্তমানে এই ছাপাখানার দায়িত্ব এসে পড়ে সুকুমার রায়ের ওপর। সুকুমার রায়ের আমলে এই ছাপাখানা প্রভুত সুনাম অর্জন করে। কিন্তু সুকুমার রায়ের অকাল প্রয়াণে অনাথ হয়ে পড়ে এই ছাপাখানা। আর সময়ের যাঁতাকলে দেখভালের অভাবে অবশেষে নিলামের অন্ধকারে হারিয়ে যায় ‘ইউ রে এন্ড সন্স কোম্পানি’। ভারতের মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। যিনি তার আবিষ্কার, সাহিত্য চর্চা, শিল্পানুরাগ, উদ্ভাবনী শক্তি, অঙ্কন শিল্পের মধ্যে দিয়ে চির উজ্জীবিত থাকবেন বাঙালির মনে।
Discussion about this post