“Culture is learned, shared and transmitted” অর্থাৎ সংস্কৃতি শেখা হয়, ভাগ হয় ও অন্যান্য সংস্কৃতির মধ্যে প্রেরিতও হয়। কোন একটি সভ্যতার সংস্কৃতি গন্ডিবদ্ধ নয় সেটি সর্বদা আবহমান। আবার প্রতিটি সংস্কৃতিতে কিছু মহাকাব্য আছে যা সেই সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন আমাদের রামায়ণ ও মহাভারত। চর্তুদশ শতকের এই মহাকাব্য শুধু এদেশেই জনপ্রিয় নয়, এটি পৌঁছে গেছে সদূর থাইল্যান্ডে। পুরান মতে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হলেন রামচন্দ্র। আর এই রামায়ণের কাহিনী তৈরী হয়েছে রামকে কেন্দ্র করে। আজও রামকে ন্যায়নিষ্ঠা ও ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। প্রাচীনকালে সুবিচারসম্পন্ন ও ন্যায়নিষ্ঠ যেকোন রাজ্যকে রামরাজ্য হিসেবে অভিহিত করা হতো।
ভারতবর্ষ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানান দেশে রামচন্দ্র পরম পূজনীয়। এমনকি আছে ইউনেস্কো স্বীকৃত অযোধ্যা!বৌদ্ধপ্রধান থাইল্যান্ডের জাতীয় গ্রন্থ রামায়ণ , এখানে তাঁর নাম ‘ফ্রা রাম’। ভারতবর্ষ থেকে যখন রামায়ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন এর কাহিনীতে কিছু পরিবেশগত ও ভাষাগত পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন লক্ষ্য করা যায়। তবে মূল চরিত্রগুলো ও ঘটনাগুলোর তেমন কোন অদল বদল হয়নি। দেশভেদে বদলে গেছে মহাকাব্যের নাম, যেমন থাইল্যান্ডে রামায়ণের নাম ‘রামাকিয়েন’। যার অর্থ হলো ‘রামের কীর্তি’।
থাইল্যান্ডে আছে অযোধ্যা, এমন কি রামরাজ্য। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাম সেখানে এখনও বাস করে আসছেন বংশপরাম্পরায় । বৌদ্ধধর্মমতে বোধিসত্ত্ব কোন এক সময়ে রামচন্দ্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মে রামচন্দ্রকে পরম ধার্মিক এবং আদর্শ রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরেও থাইল্যান্ডের রাজাকে সেখানকার বাসিন্দারা রামের বংশধর এবং বিষ্ণুর অবতার হিসাবে মান্য করেন। থাইল্যান্ডের রাজাদের রাম উপাধী ধারণের অনেক আগে খ্রিষ্টীয় তেরো থেকে পনেরো শতাব্দীতে ‘রামাকিয়েন’ লেখা হয়েছিল। রাজা ফুত্তায়োতফা চুলালোক নিজের উপাধি রাখেন প্রথম-রাম এবং তিনি নতুন করে স্থানীয় ভাষায় রামায়ণ লেখান। থাইল্যান্ডের লোকগল্প ও লোকশিল্পেও রামায়ণের গভীর প্রভাব আছে। থাইল্যান্ড সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আজও সেখানে ‘রামাকিয়েন’ পালা ও পুতুল নাচ মঞ্চস্থ হয়।
এই দেশেরই এক বিখ্যাত থিয়েটার হল থোন থিয়েটার যার মূল উপজীব্য হল এই রামাকিয়েন। সেখানে ‘রামাকিয়েন’ মহাকাব্যের বানর, রাক্ষসের চরিত্র উপস্থাপনের সময় ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ ব্যবহার করা হয়। এই ঐতিহ্যবাহী মুখোশ ‘পাপিয়ের মাশে’ নামে পরিচিত। এছাড়া অলঙ্করণ, যুদ্ধের বর্ম, অস্ত্র ও রাজকীয় মুকুটের প্রদর্শন তো আছেই। ‘খোন’ থিয়েটারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হল যুদ্ধদৃশ্য। রামাকিয়েন প্রদর্শনীতে থাই শাস্ত্রীয় নাচের প্রায় সবদিক ব্যবহৃত হয়, যা স্থানীয় ভাষায় ‘নাতাসিন’ নামে পরিচিত। এখানে বানর ও রাক্ষসদের চরিত্র অভিনয়ের আবার নিজস্ব ধরন রয়েছে। চরিত্রগুলোর বাহ্যিক উপস্থাপনে বীরত্ব বোঝানোর জন্য থাই মার্শাল মুয়াইথাইয়ের ব্যবহার করা হয়। আবার এর কস্টিউম ডিজাইনে ভারতীয় পৌরাণিক শিল্পের ছোঁয়া রয়েছে।
শুধু থাইল্যান্ডই নয় ফিলিপিনস, কম্বোডিয়া, জাভা, ইত্যাদি এই অঞ্চলগুলিতেও রাম ততটাই জনপ্রিয় যতটা ভারতে। এই ভাবেই প্রতিটা সংস্কৃতি ছড়িয়ে যাক চারিপাশে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক। ভেদাভেদ দূর হোক তবেই তো গড়ে উঠবে এক সুন্দর পৃথিবী।
Discussion about this post