তখন ক্লাস টেন, প্রথম বারের জন্য শুনি সুমনের গান। লোকটার কথা আগে শুনেছি বেশ কয়েকবার, কিন্তু তাঁর গান মনের কাছে ঠিকমত পৌঁছে দেওয়ার কেউ ছিল না। থাকতাম ভাড়া বাড়িতে। বলাই বাহুল্য, সেই পরিবেশে কবীর সুমনের গান শোনার মত তেমন কেউই ছিল না। প্রথম একজনের রেডিও বা রেকর্ডারে শুনলাম, “যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা, কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা।” ব্যাস, স্কুল থেকে ফেরার সময় এক ধাক্কায় উড়ে গিয়েছিলাম। তখন চারপাশে যেসব গান শুনতাম তার ভাষা আর এই লোকটার গানের ভাষার যে কী আকাশ পাতাল তফাৎ! সত্যি, এই ভাবেও লেখা যায়! পরে জেনেছিলাম লোকটার নাম কবীর সুমন।
মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের দিকে যাওয়ার সময় আরও জোরদারভাবে সুমন শুনতে শুরু করি। ততদিনে একে একে ‘কে বেশি পাগল কবি না কবিতা’, ‘উত্তর আসবেনা তুমি আসবেই আমি জানি’ থেকে শুরু করে “এ তেমন গান নয় যে গানে দুঃখ ভোলা যায়”, “একটি মন ছোঁয় যখন আর একটি মন বিস্ফোরণ” ইত্যাদি সবই প্রায় শোনা হয়ে গিয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের পর কলেজ। এরপর শুরু অন্য সুমন শোনা। ‘ছত্রধরের গান’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘হো চি মিন’, ‘সুফিয়া কামাল’ এই ধরণের কত গান যে শুনতে শুরু করলাম! অন্যদিকে শুরু করলাম ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’, ‘নয়নতারা’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ এসব কালজয়ী গানগুলিও। যখনই দুঃখ পেয়েছি সুমন আমাকে মনে করিয়েছেন, “দুখে আছো যারা বেঁচে থাকো, এ দুখ রইবে না।” আবার “কখন তোমার দেখা পাব, চোখের পাতায় চুমু খাব” শুনে ভীষণ ভাবে উথাল-পাতাল ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে কাউকে। ভালবাসায় লেঙ্গি খেয়ে শুনেছি “প্রথম প্রেমে পড়ার পর সবাই পস্তায়।” আবার “যদি কেউ বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও” বা “ইচ্ছে করে সবার দু’হাত ভরে উঠুক, সবার রান্না ঘরে ভাতের গন্ধ ছুটুক” এই গানগুলি আমায় ছুঁড়ে ফেলেছে কলকাতার ফুটপাথে, গ্রামে গঞ্জে মানুষের ভিড়ে।
আজও মন খারাপ হলে সুমনের গান কানে বাজে আপনা থেকেই। জীবনের প্রতিটা ওঠা-নামায় সুমনের গান লেগে রয়েছে। প্রতিদিন বেঁচে থাকতে গেলে সুমনের গান দরকার পড়ে আমার। দম বন্ধ হয়ে এলে তাজা অক্সিজেনের কাজ করে সুমনের গান। আমার কাছে সুমন বলতে “আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”, সুমন বলতে “যেন কবীর সুমন মানে আমি কবীরের সন্তান”, থেকে সুমন বলতে “এসো প্রেম পরো যোদ্ধার সাজ” সব। হ্যাঁ, সবই! আমার সব কাজের, সব ভাবনার প্রথম রসদ কবীর সুমনের গান।
প্রতিবেদক সপ্তর্ষি বৈশ্য
Discussion about this post