পদার্থবিদ্যার মতে,পৃথিবীতে শক্তি অবিনশ্বর অর্থাৎ শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ করা সম্ভব নয় শুধু শক্তির রুপান্তর সম্ভব। যদি শক্তির ধ্বংস সম্ভবই না হয় তাহলে আমরা এই শক্তি সঞ্চয় বা বাঁচানোর চেষ্টা করি কেন?
আসুন তাহলে একটা উদাহরণ দিয়েই বলা যাক, একটি গাড়ি চলে জীবাশ্ম জ্বালানিতে। মানে পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি আরকি। এই জ্বালানি প্রথমে রাসায়নিক ও পরে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর হয় ও গাড়ি চলতে থাকে। প্রশ্ন হলো এখানে তো শক্তির রূপান্তর হলো তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? ব্যাপারটা হলো এই যে শক্তির রূপান্তর হল সেটা ওই জ্বালানি খরচের বিনিময়ে। মানে আমরা জ্বালানিটা খরচ করে ফেললাম। এই জ্বালানি কিন্তু হঠাৎ করে সৃষ্টি হয় না। বহু বছর ধরে মাটির নিচে বিশাল উচ্চ চাপে জমে থেকে এই জীবাশ্ম জ্বালানি তৈরি হয়। যা কোনো সহজ প্রক্রিয়াতে পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে একটা সময় এমন আসবে যে ভূ-অভ্যন্তরে থাকা এই জ্বালানি একদিন ফুরিয়ে যাবে। তখন মানবজীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে আর সেই কারণেই আমরা শক্তি বাঁচানোর বা সঞ্চয়ের চেষ্টা করি। এই হল মোদ্দা কথা।
কিন্তু এমন যদি হয় যে এক অফুরন্ত শক্তির উৎস থেকে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ শক্তি আমরা পেতে পারি কত ভালোই হয় না! এমন এক উৎসের কথা তো সবার জানা-সৌর শক্তি। এতে আর নতুন কি? বিষয়টি হচ্ছে এই সূর্যের ওই বিপুল শক্তিকে আহরণ করে যদি পৃথিবীতে আনা যায় তাহলে কোনোদিন আর আমাদের শক্তির ঘাটতি ঘটবে না। কিন্তু এটা তো অসম্ভব! কি তাই ভাবছেন তো? তাহলে আসুন বিষয়টি একটু বিশদে বলা যাক। এই বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেছিলেন ফ্রিম্যান ডাইসন ১৯৬০ সালে তাঁর এক গবেষণা পত্রে। তিনি বলেন সূর্য বা ওই রূপ নক্ষত্রের চারপাশে এক গঠন বা স্থাপনার কথা যা সূর্য বা ওই নক্ষত্র থেকে প্রতিনিয়ত শক্তি আহরণ করে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবে। যা ‘ডাইসন গোলক’ নামে পরিচিত। ১৯৩৭ সালে ‘স্টার মেকার’ নামে এক উপন্যাস পরে প্রথম তাঁর মাথায় এই চিন্তা আসে।
এমন কিছু যদি করা সম্ভব হয় অর্থাৎ সূর্যের শক্তির যদি খুব সামান্য পরিমাণ শক্তি আহরণ করা যায় তবে মানবজাতিকে আর অন্য শক্তির উপর নির্ভর করতে হবেনা। কারণ সূর্য এমন এক অগ্নিকুন্ড যার মধ্যে নিহিত শক্তি সম্পূর্ণ পৃথিবীতে সঞ্চিত শক্তির ১০০কুইন্টিলিয়ন (১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০) গুন আর প্রতি সেকেন্ডে সেখানে এক ট্রিলিয়ন পারমানবিক বোমার পরিমান শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে। তাই এই শক্তির সামান্য নয় যদি পুরোটাই আহরণ করতে হয় তাহলে দরকার ডাইসন গোলকের। কিন্তু বিষয়টি যতটা সহজ শুনতে ঠিক ততটাই কঠিন বাস্তবায়ন করা। কারণ সূর্যের কাছে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তাহলে এই গোলক সৃষ্টির উপায় কী?
এর উত্তরও বিজ্ঞানী ডাইসন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে সূর্যের চারপাশে সোলার প্যানেলের মতো একধরণের প্যানেল স্থাপন করা যা সূর্যকে প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিণ করতে থাকবে। এটিকে বলা হয় ‘ডাইসন Swarm’। কিন্তু এটিও এত সহজ সাধ্য নয়। সূর্য পৃথিবীর থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়, যদি আমরা স্যাটেলাইট এর কথাই ভাবি তাহলেও সেটা খুব সহজ নয়। কারণ আমরা যদি ধরেই নিই যে প্রতিটি স্যাটেলাইট ১ বর্গকিলোমিটার এর সমান তাতেও ওই প্যানেল বানাতে লাগবে প্রায় ৩০ কোয়াড্রইলন (৩০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০) স্যাটেলাইটের। এর জন্য প্রয়োজন ১০০ কুইন্টিলিওন উপাদানের। শুধু তাই নয়, মহাশূন্যে স্থাপনের জন্য একটি অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ এক কথায় ডাইসন গোলক তৈরি করতে আমাদের উপকরণ, নকশা, শক্তি এই তিনটি মূল বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
এই বিশাল ব্যবস্থাটি তৈরি করতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি, উপাদান আর অর্থ দরকার তার জন্য সম্পূর্ণ পৃথিবী এখনো প্রস্তুত নয় । তবে এই রূপ অফুরন্ত শক্তিকে আহরণ করা অসম্ভবও নয়। শুধু ব্যয়বহুল। প্রযুক্তির যে উন্নতি আজ আমাদের সমস্ত পৃথিবীর হচ্ছে তার হাত ধরে গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞান মহল যদি এক হয়ে এই কাজ সম্পন্ন করতে চায় তাহলে আগামী ১০ বছরেই এই অসাধ্য সাধন হবে এবং আমরা এমন এক শক্তির উৎস পাবো যার পর আমাদের আর অন্য কোনো শক্তির প্রয়োজন হবে না।
চিত্র ঋণ – earthsky
Discussion about this post