বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে লাকুড্ডিতে অবস্থিত দুর্লভা কালী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত তীর্থস্থান। শুধুমাত্র মন্দিরটির স্থাপত্য শৈলী বা পুরাতন ইতিহাসই নয়, এর সাথে জড়িত রহস্যময় গল্পগুলিও মানুষকে আকৃষ্ট করে। এই মন্দিরটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এবং এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন রহস্য।
কথিত আছে, গোকুলানন্দ ব্রহ্মচারী নামে একজন সাধক ছিলেন। তাঁর তপস্যার ফলে দেবী কালী তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে এই মন্দির স্থাপনের আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। গোকুলানন্দ তখন বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদ মহতাবের কাছে এই মন্দির স্থাপনের অনুমতি চেয়েছিলেন। মহারাজ তাঁর দৈবশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে গোকুলানন্দকে ১০ বিঘে জমি দান করেছিলেন এবং মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করেছিলেন। দেবীর নাম দুর্লভা হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। একটি প্রচলিত মত অনুযায়ী, গোকুলানন্দের দেহত্যাগের পরে দুর্লভ ভট্টাচার্য নামে এক পুরোহিতকে নিয়োগ করা হয়। পুরোহিতের নামানুসারেই দেবীর নাম দুর্লভা কালী রাখা হয়। অন্য একটি মত অনুযায়ী, দেবীর দুর্লভ সৌন্দর্য্যের কারণে তাঁকে দুর্লভা কালী বলা হয়। মন্দিরের অবস্থান এবং নামকরণ নিয়ে আরেকটিও মজার ঘটনা রয়েছে। এক সময় এই স্থানে ঘন জঙ্গল ছিল। তাই এই দেবীকে দর্শন করা ছিল অত্যন্ত দুর্লভ। এই কারণেই হয়তো তাঁকে দুর্লভা কালী বলা হয়।
দুর্লভা কালী মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল এর রহস্যময় প্রথা এবং বিশ্বাস। মন্দিরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিবাভোগ শিয়ালকে খাওয়ানো হয়। এই প্রথার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই প্রথা শুরু হয়েছিল মন্দিরের আশেপাশের জঙ্গলে শিয়ালের উপদ্রবের কারণে। আবার কেউ কেউ বলেন, এই প্রথা দেবীর ইচ্ছা অনুযায়ী শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে শিয়াল না থাকলেও মায়ের পুজোর শেষে সেই ভোগ এখনও শিয়ালের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়। কাক-পক্ষীরা এসে সেই ভোগ খেয়ে যায়। এছাড়াও, মন্দিরের সাথে আরও অনেক রহস্যময় ঘটনা জড়িত। বলা হয়, মন্দিরে অনেকবার অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই মন্দিরে আসলেই দেবীর অদৃশ্য উপস্থিতি রয়েছে।
কথিত আছে, ডাকাতরাও এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন। বর্তমানে মন্দিরে শ্বেতপাথরের তৈরি দেবীর মূর্তি পূজিত হয়। শুধুমাত্র কালী পুজোর সময় ঘটা করে দুর্লভা মায়ের পুজো হয়, এমনটা কিন্তু নয়। দুর্গাপুজোর চার দিন মন্দিরে পূজিত হন দেবী দুর্লভা। আর কার্তিকের অমাবস্যা তিথিতে রাতভর দেবী দুর্লভার পুজোপাঠ চলে। সময়ের সাথে সাথে মন্দিরের চারপাশের পরিবেশ অনেক বদলে গেলেও মন্দিরের আধ্যাত্মিক শক্তি আজও অক্ষত রয়েছে। মন্দিরে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্তের ভিড় জমে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন মায়ের দর্শন করতে। বর্ধমানের দুর্লভা কালী মন্দির শুধুমাত্র একটি মন্দির নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি সংস্কৃতি এবং একটি বিশ্বাসের কেন্দ্র। মন্দিরের সাথে জড়িত রহস্যময় গল্পগুলি মানুষের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। এই মন্দিরটি একটি জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী, যা আজও মানুষের মনে আস্থা ও শান্তি দিয়ে চলে।
চিত্র ঋণ – মধুমন্তী বসু, শুভেন্দু মন্ডল, শুভদ্বীপ দে
Discussion about this post