বারাসাতের দক্ষিণপাড়ায় শিবকুঠির দুর্গা পুজো প্রায় ৪৫৪ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যা স্থানীয় মানুষের জন্য শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সংস্কৃতির এক অমূল্য নিদর্শন। এই পুজোর বিশেষত্ব হল প্রথা ও বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিত আচার-অনুষ্ঠান, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অক্ষুণ্ণভাবে সংরক্ষিত। পুজোর প্রতিটি দিনের ভোগ, ধুনো পোড়ানো ও স্থানীয় আনুষ্ঠানিকতা আজও সেই পুরনো কাঠামোতেই পালন করা হয়, যা ইতিহাসের সঙ্গে জীবন্ত যোগসূত্র তৈরি করে।
পুজোর অষ্টমীতে শিবকুঠির সবচেয়ে বিশেষ রীতি হল ধুনো পোড়ানো। এলাকার প্রবীণ মহিলারা দেবীর মূর্তির সামনে ধুনো পোড়ান, তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আশেপাশের মানুষজন তাদের কোলে বসে আশীর্বাদ পান। তাঁদের বিশ্বাস, প্রবীণ মহিলাদের কোলে বসলে সারা বছর শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এভাবেই প্রায় ৪৫৪ বছর ধরে বারাসাতের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো স্থানীয় মানুষের মধ্যে আশীর্বাদ, ভক্তি ও ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে পরিচিত।

পুজোর ক’দিন প্রতিদিনই বাড়িতে ভোগের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু দশমীর দিন ঊমা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন পান্তাভাত ও কচু শাক খেয়ে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই দেবী প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয় এবং সেই বিসর্জনের পরই সত্যনারায়ণের পুজো করে বিজয়া দশমী সম্পূর্ণ হয়। এই প্রথা শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ও সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার প্রতীক। শিবকুঠির পুজোর এই বিশেষ মুহূর্তটি বারাসাতের মানুষের হৃদয়ে একটি অমোঘ ছাপ ফেলে।

এই পুজোর ইতিহাস আরও গভীর। জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবর বারো ভুইয়াদের মধ্যে ১১ জনকে বশে আনলেও প্রতাপাদিত্যকে আটকাতে পারেননি। প্রতাপাদিত্যর প্রধান সেনাপতি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করা হয়, যিনি কারাগারে অবস্থানকালে দুর্গা পুজোর সূচনা করেন। শঙ্করের এই উদ্যোগই আজকের শিবকুঠির পুজোর মূল ভিত্তি। প্রাচীন সেই কাঠামোতে আজও পুজো অনুষ্ঠিত হয়। আগে বলি ব্যবহার হত, বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেলেও পুজোর আচার ও ভক্তি সেই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। বারাসাতের এই চট্টোপাধ্যায়দের পুজো স্থানীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক মূল্যবান পরিচয় বহন করে।
Discussion about this post