সময়টা ১৯১৯। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনে জর্জরিত বাংলায় তখন লেগেছে বিপ্লবের জোয়ার। সেই জোয়ারের ঢেউয়ে নতুন করে জেগে উঠেছে স্বদেশী চিন্তাধারার প্রভাব। ছোটোখাটো বিপ্লবীদের বৈঠক গড়ে উঠতে লাগল এদিক ওদিক। কিন্তু সবাইকে তো একসঙ্গে মিলিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বিপ্লবে। এদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর চোখের সামনে মেলামেশা করাও যে যথেষ্ট উদ্বেগের। তবে উপায়? তখনই বিপ্লবীদের মাথায় এল এক অভিনব পন্থা- দুর্গা পুজো। একমাত্র পুজোতেই সকল শ্রেণীর মানুষ একত্রে, নির্ভয়ে মিলিত হতে পারবে। আর তার আড়ালেই চলতে থাকবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা! অর্থাৎ একাধারে যেমন চলবে মাতৃ আরাধনা তেমনই অন্যদিকে জারি থাকবে ব্রিটিশ-অসুর নিধনের প্রস্তুতি পর্বও।
তৎকালীন সময়ে বহু নামকরা বিপ্লবীই যুক্ত হয়েছিলেন এই উৎসবে। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের বেড়াজাল ছিন্ন করতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও বেছে নিয়েছিলেন এই দুর্গা পুজোকেই। বেশ কিছু বারোয়ারী পুজোর সঙ্গেও যুক্ত হন তিনি। তার কাছে উৎসব ছিল জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশী চেতনা এবং একাত্ববোধ জাগিয়ে তোলার এক মঞ্চ। উত্তর কলকাতার বাগবাজার, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি এবং দক্ষিণ কলকাতার আদি লেক পল্লী এবং মধ্য কলকাতার ৪৭ পল্লীর মতো বিভিন্ন বারোয়ারীর পুজোতেই সময় বিশেষে উপস্থিত থাকতেন নেতাজী। তাঁকে একবার চাক্ষুষ দেখার জন্য চারপাশে জমে যেত ভীড়। আর সেখানেই তিনি স্বদেশী আন্দোলনের দীক্ষা দিতেন দর্শকদেরও।
নেতাজী ছাড়াও বিপ্লবী চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অতীন্দ্রনাথ বসু সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীই দুর্গা পুজোকে বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার আন্দোলনের আঁতুড়ঘর হিসাবে। অতীন্দ্রনাথ বসুই প্রথম সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো শুরু করেন। এই সমিতিতে সারা বছরই লাঠি খেলা, কুস্তি, তলোয়ার চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। তবে সমিতিতে দেবীর আরাধনা শুরু হলে, মহাষ্টমীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হতো শরীর চর্চা এবং সাহসিকতা পরীক্ষার দিন হিসাবে। সেসময় এই দিনটিকে ‘বীরাষ্টমী দিবস’ হিসাবে পালন করা হত। দেবী প্রতিমার সামনেই বসত শরীর চর্চার আসর। তলোয়ার খেলা, লাঠি খেলা, ছুঁড়ি খেলা, কুস্তি কী-ই না ছিল সেখানে। নেতাজী ছাড়াও এতে যোগ দিতেন নেতাজীর দাদা শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বহু নামকরা বিপ্লবীই। তাঁদের সান্নিধ্যে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালিত হত মহা অষ্টমীর সেই অনুষ্ঠান।
১৯৩০ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন নেতাজী। তাঁর উদ্যোগেই সে বছর দেবী প্রতিমাকে পরানো হয় স্বদেশীয় খাদির শাড়ি। অস্ত্রগুলি সবই লোহা এবং তামার। মাটির গয়নাতেই স্বালঙ্কারা হয়েছিলেন দেবী। মন্ডপে শোভা পায় বৈপ্লবিক বাণী লেখা বিভিন্ন পোস্টারও। তৎকালীন ইংরাজি এক পত্রিকা ‘অ্যাডভান্স’ এই প্রতিমাকে ‘স্বদেশী ঠাকুর’ হিসাবেও অ্যাখায়িত করে। ব্রিটিশদের স্বার্থে তীব্র হানা দাগতেও বেশ সক্ষম হয়েছিল সিমলার এই পুজো। অবশ্য স্বদেশী বিপ্লবীদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় শেষমেশ ১৯৩২ সাল নাগাদ নিষিদ্ধই হয়ে যায় এই পুজো। তবে এর ঠিক সাত বছর পরই, স্বামীজির ভাই মহেন্দ্র দত্তের উদ্যোগ পুনরায় চালু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো।
একসময় বাগবাজারের পুরো সঙ্গেও যুক্ত হন নেতাজী। পুজোর সভাপতিও ছিলেন তিনি। শুধু সিমলাতেই নয়, বাগবাজারের পুজো প্রাঙ্গণেও অনুশীলন সমিতির শরীর চর্চা এবং লাঠিখেলার প্রদর্শন করা হতো এবং তা হতো বিরাষ্টমীর দিনই। ১৯৩৬ সাল নাগাদ কবিগুরুর ভাইঝি সরলা দেবীই প্রথম সেখানে উদ্বোধন করেন এই অনুষ্ঠান। বাগবাজারের সেই বিরাষ্টমীর উৎসব আজও বর্তমান। এছাড়াও পুতুল খেলা, যাত্রা এবং কবিয়াল গানের আসরও বসতো বিভিন্ন বারোয়ারীতেই।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চালু হওয়া এই উৎসবগুলিকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল জাতীয়তাবাদের নবজাগরণ। বারোয়ারী পুজো হয়ে ওঠে আন্দোলনের এক মাধ্যম। দিকে দিকে তখন মানুষকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আন্দোলনের আগুনে নিজেদের পোড়াতে নতুন রূপেই এগিয়ে আসেন আরও বহু বিপ্লবীই। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হিসাবে পরিচিত দুর্গা পুজোই তখন হয়ে ওঠে বিপ্লব চেতনার অন্য নাম। ভারতের আকাশে উঁকি দিতে থাকে আসন্ন স্বাধীনতার নতুন সূর্যের আভাস…
Discussion about this post