দুর্গা পুজো বাঙালির প্রাণের উৎসব। প্রাণের টান না থাকলে কি আর পুজোর রেওয়াজে ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি বা ভালোবাসা মিলে মিশে একাকার হয়ে হতে পারে? বনেদি বাড়ির পুজো গুলোর দিকে চোখ ফেরালেই যাচাই করতে পারবেন এ কথার সত্যতা। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উঠে হাওড়া জেলার চক্রবর্তী বাড়ির দুর্গা পুজোর কথা। এখানকার প্রাচীন বনেদি পরিবারের মধ্যে অন্যতম একটি দুর্গা পুজো। এখানে মা পূজিত হন সর্বমঙ্গলা রূপে। জমিদার বাড়ির পুজো না হলেও এই পুজোর সাথে জড়িয়ে মায়ের এক আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক কাহিনী।
সালটা ১৯৪১। ঝিকিরার বাসিন্দা স্বর্গীয় ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রথম এই পূজার সূচনা করেছিলেন। সময়ের পরিবর্তনে পরিবারের সকল সদস্যরা বর্তমানে হাওড়ার বকুলতলা লেনে রামরাজাতলা এলাকায় চলে আসেন। কথিত আছে, মা কালীর স্বপ্নাদেশে চক্রবর্তী বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় বুড়িমার ও মা মঙ্গলা কালীর মন্দির। পরে মায়ের স্বপ্নাদেশেই এখানে মা দুর্গার পুজোও শুরু হয়। প্রথমে পুজা হত ঘট ও মায়ের পট চিত্র এবং নবপত্রিকাতে। পরে মা মঙ্গলার নির্দেশে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তির আরাধনা শুরু হয়। আগে নিজেদের বাড়িতেই ওনারা প্রতিমা তৈরির আয়োজন করতেন। কালের নিয়মে এখন কুমোরটুলি থেকেই আনা হয় প্রতিমাকে। রথের পরে যে প্রথম শনিবার আসে সেই দিন মূর্তির মূল্য পুজো দিয়ে মায়ের পুজোর সূচনা হয়। বর্তমানে কুমোরটুলির মহিলা শিল্পী কাকুলি পালের হাত ধরেই তৈরি হয় চক্রবর্তী বাড়ির মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তি।
এ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী মহালয়ার আগের দিন অর্থাৎ মাতৃপক্ষ শুরুর আগের দিন মূর্তি নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। তবে মায়ের বোধন হয় মহাষষ্ঠীতেই। ব্রাহ্মণ পরিবার তাই পরিবারের সদস্যরাই পুজোর প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পাঁচ দিন ধরে মায়ের বিশেষ পুজো চলে সম্পূর্ণ শাক্ত মতে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী- এই তিন দিনই মাকে নানান পদের ভোগ নিবেদন করার রেওয়াজ রয়েছে। এই বাড়ির বিশেষত্ব ফুটে ওঠে ভোগ নিবেদন পর্বেই। সপ্তমীতে দেবীকে নিবেদন করা হয় অন্নভোগ এবং সাথে থাকে শুক্তো, ভাজা, ডাল, তরকারি, পরমান্ন এবং আরও নানা পদ। বাঙালির কাছে অষ্টমী মানেই লুচি! ভোগে তাই থাকে লুচি ,আলুর দম, সুজি ও মিষ্টি। নবমীতে হয় পোলাও, আলুর দম ,পনিরের তরকারি, চাটনি ও পরমান্ন। দশমীতে হয় দধিকর্মা।
এ বাড়ির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আরেকটি হল সন্ধিপুজোতে বলি নিষিদ্ধ তাই মাকে দেওয়া হয় বেল পাতার মালা। এবার দশমীর পালা! মন খারাপের সময় উপস্থিত। দশমীতে অপরাজিত পুজোর পর হাওড়া ময়দান সংলগ্ন গঙ্গার অর্থাৎ রামকৃষ্ণপুর ঘাটে বিষাদ ভরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এভাবেই বংশ পরম্পরায় প্রতি বছর মায়ের আরাধনায় মেতে ওঠে গোটা চক্রবর্তী পরিবার। এত বছর পরেও তাদের বনেদি বাড়ির জৌলুস টিকিয়ে রেখেছেন পুজোর ধারক ও বাহক ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পরবর্তী প্রজন্ম। তবে দুগ্গা পুজো পাঁচ দিন ধরে চললেও এই বাড়িতে সারা বছরই বিভিন্ন সময়ে চলে মায়ের বিভিন্ন রূপের আরাধনা. তাই উৎসব মুখর থাকে হাওড়া জেলার এই চক্রবর্তী পরিবার।
Discussion about this post