সেই এক সময় ছিল। কুলিক নদীপথে বড় বড় পালতোলা নৌকায় বণিকরা রওনা দিত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, লক্ষ্মী লাভের আশায়। সেই সময়ের গল্প। তবুও ৫৭৫ বছর তো হবেই। সেই রকমই একদল বণিক এলেন অধুনা বাংলাদেশ থেকে। নোঙর ফেললেন কুলিক নদীর ধারে। নতুন জায়গায় তাদের ব্যবসা বেশ ভালোই হল। সেই থেকে ব্যবসার নতুন ঠিকানা হল এই বন্দর। প্রতি বছরই তারা সকলে আসেন এই বাণিজ্য স্থলে।

এরই মাঝে তাদের একজন স্বপ্নে আদেশ পেলেন দেবী দুর্গার। তিনি সেই মতো কুলিক নদীর ধারে আয়োজন করলেন দুর্গাপুজোর।পুজোয় এগিয়ে এলেন বাকিরাও। তৈরী হল মন্দির। সেই শুরু, বন্দরটি আছে রায়গঞ্জে। উত্তর দিনাজপুরের সদর শহর। এলাকার সবচেয়ে পুরোনো দুর্গাপুজো আজও শহর বাসীর উদ্যোগে মহা ধূমধাম করে পালিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সেই মন্দিরের বর্তমান নাম ‘রাইগঞ্জ আদি সার্বজনীন দুর্গামন্দির’। তবে সেই আদি মন্দির বন্যায় ভেসে গিয়েছে কবে। নতুন করে বাঁশের বেড়া দিয়ে মন্দির তৈরী করা হয়েছিল। আর উপরের ছাদ বলতে টিনের চালা। কিন্তু কুলিক নদীর জল ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই মন্দিরও। তাই পরবর্তীকালে ইট-চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি করা হয় নতুন পাকা মন্দির। ২০০৮ সালে পুনরায় সংস্কার করা হয় সেই মন্দিরের।
শহরবাসীর আবেগ ঘিরে আছে এই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। এই পুজোর ঐতিহ্যের আকর্ষণেই জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে দর্শনার্থীর দল।মা যে তাদের পরম মমতাময়ী। তাদের বিশ্বাস মায়ের কাছে মন থেকে ভক্তিভরে কিছু চাইলে মা তাঁর ইচ্ছের সবটা পূরণ করেন। তারা নিজে থেকেই এসে চাঁদা দিয়ে যান পুজো উপলক্ষ্যে। এবং সেই অর্থেই প্রতিবছর মহাড়ম্বরে পালন হয়ে আসছে এই বর্ষ প্রাচীন পুজো। পঞ্চমীতে মাকে সাজানো হয় বেনারসি শাড়িতে। তাঁকে স্থাপন করা হয় হয় পঞ্চমুন্ডির আসনে। অষ্টমীতে অঞ্জলির ভিড় কার্যত অবাক করবার মতো। ভক্তদের কাছ থেকে মায়ের ভোগের ডালা আসে প্রায় হাজার খানেক! চার দিনই পুজোয় রাখা হয় না কোনোরকম খামতি। পাত পেড়ে খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ানোর আয়োজন করে পুজো কমিটি।
অবশেষে মায়ের কৈলাসে ফেরা। দশমীর পুজো শেষে সিদ্ধি প্রসাদ থেকে বঞ্চিত করা হয় না আগত কোনো দর্শনার্থীকেই। সবশেষে প্রতিমা নিরঞ্জনের পালা। নৌকায় করে প্রতিমা বিসর্জন হয় কুলিক নদীর জলে। তবে প্রতিমা কাঠামো নিয়ে আসা হয় আবার। এই পুরোনো কাঠামোতেই পুজো হয়ে আসছে এতদিন। যদিও ১৯৫৩ সালে কুলিকে বন্যায় ভেসে যায় আদি কাঠামো। ফলে নতুন করে তৈরি করা হয় কাঠামো। আগে এই পুজোকে কেন্দ্র করে মন্দির চত্বরে মেলা বসত। তবে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান জনবসতির চাপে মেলার আয়তন ছোট হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু কোনোভাবেই কমেনি পূজাকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনা। কেমন করে যেন কুলিক নদী, একদল বণিক, সংস্কৃতি, মানুষের বিশ্বাস সব মিলেমিশে একাকার এখানে। ইতিহাস হয়তো এভাবেই গড়ে ওঠে!
Discussion about this post