বাঙালি জীবনে দুর্গা পুজোর জায়গাটা শুধু ধর্মীয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। আর এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনেদি বাড়ির পুজো, যা একইসাথে আভিজাত্য এবং পারিবারিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটায় প্রতি বছর। আর এই বনেদি বাড়ির পুজোর তালিকায় অন্যতম হলো পাণ্ডুয়ার ঘোষবাড়ির পুজো, যা স্থানীয়দের কাছে সাহেব বাড়ির দুর্গাপুজো নামেও পরিচিত। সেই ইংরেজ আমল থেকে পাণ্ডুয়ার সাহেব বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়ে আসছে একই রীতিতে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, ঘোষবাড়ির মা দুর্গা অত্যন্ত জাগ্রত। তাই স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রাণভরে মায়ের আরাধনা করেন এই চারটি দিন।
ঘোষবাড়ির পুজোকে ঘিরে আছে নানা ধরনের উপকথা। শোনা যায়, একবার নাকি অষ্টমীর সন্ধিপুজোর সময় পদ্ম নিয়ে ঘটেছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। সেবার মায়ের সন্ধিপুজোর ১০৮টি পদ্মের জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল ১০৭টি পদ্ম। তবে ১০৮টি পদ্ম না পাওয়া গেলে তো মায়ের সন্ধিপুজো সম্পন্ন হবেনা! সারা পাণ্ডুয়া ও আশপাশের সব গ্রামের বাজার খুঁজেও শেষ পদ্মটি পাওয়া গেলনা। সেই সময় পুরোহিত বললেন, “গোয়ালঘরে গেলে পাওয়া যাবে ওই একটি পদ্ম।” অবাক করে দিয়ে গোয়ালঘরের পাশের জবা গাছেই ফুটে ছিল একটি মাত্র পদ্মফুল, যা দিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল সন্ধিপুজোর আয়োজন।
পাণ্ডুয়ার সাহেব বাড়ির ইতিহাসও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। গৌরমোহন ঘোষ, এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথমে ছিলেন কৃষক, পরে ধান ও চালের ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময়ে ইংরেজদের সাথে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্রে ইংরেজদের নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু হয় সেই বাড়িতে আর কালক্রমে ঘোষবাড়ি হয়ে ওঠে ‘সাহেব বাড়ি’। আর এই গৌরমোহন ঘোষের আমল থেকেই কিন্তু সাহেব বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা।
শোনা যায়, একবার একদল ডাকাত, সাহেব বাড়িতে আক্রমণ করতে আসলে, মা দুর্গা স্বয়ং আবির্ভূতা হয়ে রক্ষা করেছিলেন বাড়ির মানুষদের। আর ডাকাতরা মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্য অনিমেষ ঘোষ বলেন, “এই বাড়ি মা দুর্গার নিজের বাড়ি, এবং মা বারবার বিপদের সময়ে আমাদের রক্ষা করেছেন।”
সাহেব বাড়িতে পুজো হয় ঠাকুর দালানেই। রাধাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। মহালয়ার দিন দেবীর চক্ষুদান, আর সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপুজো এবং নবমীতে ছাগবলির প্রথা এখনও পালন করা হয়। একসময় কামান দাগা হত, বাড়ির কর্তারা বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়তেন। এখন যদিও তা বন্ধ হয়েছে, তবে দশমীতে কাঁধে করে মা-কে বিসর্জনের ঘাটে নিয়ে যাওয়া এবং মশাল জ্বালিয়ে মা-কে বিদায় জানানোর রীতি আজও অব্যাহত রয়েছে।
Discussion about this post