সময়টা ১৯৯২ সাল। সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর দুঃস্থ নারী, পুরুষ ও শিশুদের সাক্ষরতার উদ্যোগ নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। রাজ্যে বিভিন্ন জেলায় পড়াবেন, এমন মানুষরা দায়িত্ব নিয়ে বাছতেন শিক্ষার স্থান। সরকার জোগান দিত বই, চক, ডাস্টার, ব্ল্যাক বোর্ড আর তেল ছাড়া হ্যারিকেন। এই ব্যবস্থা চলেছিল ৬-৭ বছর। পরে শিক্ষার কাঠামোগত জটিলতা এবং আরো সমস্যার কারণে জন্য শিক্ষাকেন্দ্রগুলি বন্ধ হয়ে যায়।
এই সময়েই এগিয়ে এসেছিল বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের শিবু দাস এবং তার দুই বন্ধু। সদ্য মাধ্যমিক পাস পনের-ষোলো বছরের ছেলেগুলি নিজেরাই বেছেছিল পুরনো বাড়ি। নিজেরাই দুঃস্থ এলাকা ঘুরে, খুঁজে আনত মহিলাদের। এরাই চালু করল ‘দুকড়িবালাদেবী মহিলা সাক্ষরতা সেন্টার’। সেন্টারের নামটি ছিল বীরভূমের বীর বিপ্লবী দুকড়িবালা দেবীর নামে। যিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালি নারী বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম। ইনিই পরাধীন ভারতে অস্ত্র আইনে শাস্তি প্রাপ্ত প্রথম মহিলা। এই বিপ্লবী নারীর নামের ছায়ায় নারীদেরই শিক্ষাদানের স্বপ্ন দেখেছিল সদ্য কিশোর শিবু দাস। অর্জন করেছিল সাফল্যও। যান্ত্রিক দায়িত্বপালনের বদলে তাদের এই কাজ হয়ে উঠেছিল অনেক মানবিক, ব্যক্তিগত।
তবে সেই সময় শিক্ষাক্ষেত্র চালানো ততখানি সহজ ছিল না। পড়াশোনার ব্যবস্থা ছিল সন্ধ্যেবেলা। কারন বেশিরভাগ মহিলা দিনের বেলা কাজে বেরতেন। শিবু দাস জানান, প্রথমে মহিলাদের সেন্টারে আনতেই বেগ পেতে হত। তাঁদের বাড়ি থেকে বেরোতেই দেওয়া হত না। সেন্টারে পৌঁছলেও বাড়ির পুরুষেরা বা মদ্যপ অবস্থায় স্বামীরা এসে জোর করে বাড়ি নিয়ে যেতেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল বাড়ির মেয়ে-বউরা আবার লেখাপড়া কি করবে, কেনই বা করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সমস্যা কাটতে লাগল। সম্পূর্ণ নিরক্ষর মহিলারাও পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে উঠতে লাগলেন। শিক্ষা সেন্টারের সবচেয়ে বয়স্ক শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ৫৯ বছর। শিবু দাস জানান, “আমরা ওনাদের ছেলের বয়সী হলেও, ওনারা আমাদের গুরু হিসেবেই সম্মান করতেন। এবং এই সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল প্রফেশনালিজমের বাইরে অনেক আন্তরিক।“ এই মহিলাদের কিছুজনের লাইব্রেরি কার্ড হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা রীতিমত লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তেন।
আজ শিবু দাসের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। তিনি বলেন সরকারি উদ্যোগের বাইরেও তাঁদের এই শিক্ষা সেন্টারের উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের শিক্ষার আঙিনায় আনা তো বটেই। তাছাড়া, “শিক্ষিত মায়ের সন্তান তো শিক্ষিত হবেই। ফলে পরবর্তী জেনারেশনও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে।“ এখনও শিবু দাস মানুষের জন্য কাজ করেন। নিজের চাকরি, সংসার, সন্তান সব সামলেই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের পাশে থাকতে চান।
Discussion about this post