চন্দননগর মানেই যেন আস্ত ইতিহাসের এক ঘাঁটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে কত জানা অজানা স্মৃতিরা। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈত্রিক বাড়ি থেকে রবিঠাকুরের আসা যাওয়া সব নিয়েই ঐতিহ্যে ভরা এই চন্দননগর। তার উপর ব্রিটিশ আমলে একঝাঁক ফরাসির আগমন। বাংলার মাঝে যেন একটুকরো ফ্রান্সের অবস্থান এই চন্দননগরে। সেথেকেই ফরাসডাঙা ফরাসিঘাঁটির উৎপত্তি। দুপ্লে মিউজিয়াম, ফরাসি সমাধিস্থল, চন্দননগর গেট, নন্দদুলাল মন্দির, রাধানাথ শিকদার হিমালয়ান মিউজিয়াম সবটার মধ্যেই রয়েছে বিদেশীদের ছাপ। তবে চন্দনগরের মন প্রাণ জুড়ানো জায়গা মানেই কিন্তু চন্দননগর স্ট্র্যান্ড। তবে এটিকে বানালো কে? ফরাসি নাকি বাঙালি?
মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবা মারা যান। সংসারের ভার পড়ল কাঁধে। ফরাসি ব্যবসায়ীর কাছে থেকে কলকাতায় কাজ শেখেন। পরে নিজ প্রচেষ্টায় চালু করলেন নিজের ব্যবসা। হয়ে উঠলেন বেশ বড়ো মাপের ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে আমদানিতে হোয়াইট লেদ, জিংক হোয়াইট, কুইনাইন, ফরাসি মদ। আর বিদেশে পাঠাতেন চাল, ডাল, চা, তিল সর্ষে, পোস্ত, তিসি, আফিম, তসরের থান ও কাটা কাপড়। মালয়েশিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, হংকং, মরিশাস, মিশরের নানা জায়গার সাথে চলত তাঁর বাণিজ্যিক লেনদেন। এমনকি প্রয়োজনের তাগিদেই নামালেন মালবাহী জাহাজও। তবে শুধুই উপার্জন নয় আপন ভিটে ও অঞ্চলের উন্নতিতে করেছেন বিশাল খরচও। চন্দননগরকে সবরকমভাবে সাজিয়ে তোলেন তিনি নিজ হাতে। শিক্ষা স্বাস্থ্য সমাজের প্রসারে এগিয়েছেন বারবার। চন্দননগরের ‘দুর্গাচরণ রক্ষিত বঙ্গ বিদ্যালয়’ আজও দু্র্গাচরণের স্মৃতি বহন করে চলে। গরিবের চিকিৎসার জন্য দোকানও খোলেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে ইচ্ছে হয় গঙ্গাতীরের এক মনোরম ঘাটের। আর তাই ১৯২২ এ তৈরী হয় চন্দননগর স্ট্র্যান্ড রোডের ওপর জোড়া ঘাট আর গঙ্গার জেটি। চওড়া ফুটপাতের ধারে ধারে নকশার কী অপূর্ব নয়নাভিরাম শিল্পের ছড়াছড়ি!
দুর্গাচরণ রক্ষিতই প্রথম বাঙালি যিনি ফ্রান্সের বিশেষ সম্মান লিজিয়ঁ দ্য অনার পান। এই বঙ্গসন্তানের কথা কি আজকের চন্দননগরবাসী জানেন! সময়ের খোলসে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর নাম। কিন্তু হারায়নি তাঁর স্থাপত্যগুলো। আজও রক্ষিত বাসভবন চন্দননগরের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে। আজও গঙ্গার ধারে ওই কারুকার্যে ভরা ছোট্ট বসার জায়গাগুলো আলাদাই ভারিক্কী তৈরী করে মনে। এইভাবেই দুর্গাচরণ রক্ষিত বেঁচে রয়েছেন আজও তাঁর প্রাণের শহর চন্দনগরে।
তথ্য ঋণ – স্বপন দাস, চিত্র ঋণ – বিশ্বরূপ গাঙ্গুলী
Discussion about this post