বাংলায় প্রাচীন শিল্পের বিলুপ্তি কিছু নতুন ঘটনা নয়। বহু বিখ্যাত শিল্প আজ হারিয়ে গিয়েছে নয়া প্রযুক্তির অতলে। ঠিক সেইরকমই হল এক সময়ের বাংলা বিখ্যাত জয়নগরের ছাঁচের পুতুল। যদিও মাটির ছাঁচের পুতুল তৈরির প্রথম সারিতে নাম লিখিয়েছে মজিলপুর, কৃষ্ণনগর, খাগড়া। তবে মন্মথ দাস ও পাঁচুগোপাল দাসের হাতে বানানো এই পুতুল ছিল বাংলা বিখ্যাত। যদিও আজ তাঁরা কেউই জীবিত নেই। পাঁচুগোপাল দাস প্রয়াত হন ২০১০ সালে। পুতুলের রং, গোলানো নিটোল চেহারা, আর গায়ের কারুকার্য ছিল দেখার মতো। যা বাকি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পাঁচুগোপাল দাসের জন্ম মজিলপুরের বোস পাড়ায়। পরিচিতি বাবু নামেই। চোখে শিল্পের বাসা বাঁধা। একদম সহজ-সরল মাটির গন্ধ মাখা শরীরে যেন মাটির মানুষ। পাঁচুবাবুর পুতুল তৈরি শেখা তাঁর কাকা মন্মথ দাসের হাত ধরেই। তাঁর হাতেই তৈরি প্রায় একশ পাঁচটা ছাঁচ। তাঁর মতন নিখুঁত পাতলা মাটির চাদরের ছাঁচ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে প্রায় অনেক ছাঁচই নোনা ধরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছাঁচের মধ্যে ছিল শিব, নারায়ণ, সরস্বতী, কৃষ্ণকালী, মাতাল শিব, কালী, যশোদা থেকে শুরু করে নন্দী ভৃঙ্গী, গণেশ, গণেশ জননী, বলরাম ও সুভদ্রা, কালীয়-দমন, জগদ্ধাত্রী, জগন্নাথ, রাধাকৃষ্ণ, বরাহ অবতার। এছাড়াও ছিল হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বেড়াল, গরু, সিংহ, মাতাল, বেনে, বেনে বউ, পিয়ন, গোয়ালা বউ, মুন্সি, বাবু-বিবি, মেম, সেপাই, বুড়োবুড়ি, বুলবুলি, কাকাতুয়া, টিয়া আরও নানান পশুপাখি।
মন্মথনাথের গড়া জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার লাভ করে। তাঁর প্রয়ানকালে সেই পুরষ্কার গ্রহণ করেন পাঁচুবাবুই। গ্রামাঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীর পুজো সবচেয়ে বেশি হয়, তাই চাহিদাও প্রচুর। তাই লৌকিক দেবদেবীর মূর্তিও যেমন দক্ষিণরায়, ঝোলা বিবি, নারায়ণী আটেশ্বর, বসন্ত রায়, বড় খাঁ গাজি, পঞ্চানন্দ, পীর গোরাচাঁদ, বনবিবি, শীতলা ইত্যাদিও তৈরি করতেন তাঁরা।
বাংলায় শিলেট, হিংলি বা মুখোশ ইত্যাদি পদ্ধতিতে গড়া হয় পুতুল। তবে এই জয়নগরের পুতুলের বিশেষত্ব অনেক। পুতুলের ভেতরটা হয় ফাঁপা। সাধারণ নিয়মেই কাঠামোর দুই ভাগ জুড়ে দেওয়া হয়। পুতুল বানানোর পর খুব ভাল করে পোড়ানো হয় এবং তারপর রং করা হয়। রং শেষ হলে চকচকে করার জন্য লাগানো হয় রজন ও গর্জন তেল। পুজো করা হয়, তাই পোড়ানো হয়না দেবদেবীর মূর্তি। শুধু কাঁচামাটি দিয়েই তৈরি হয় এই প্রতিমা। চোখ আঁকা হয় নিমপাতা, পটলচেরা বা বাঁশপাতা যা কলকাতার পুতুলের চেয়ে অনেক আলাদা। এই চোখ আঁকা শুরু করেন পাঁচুবাবুর সেজো ঠাকুরদা হরনাথ দাস। পুতুলের গড়নের সাথে কালীঘাটের পটের অনেক মিল ছিল।
বাংলায় নতুন ধারার পুতুল নির্মাণে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল জয়নগরের মজিলপুরের ছাঁচের পুতুল। এছাড়াও মাটির পুতুলের সাথে একসময় তাঁদের নিজ রীতিতেই গড়তেন দুর্গা মূর্তিও। শিল্পীদের আবেগ আজ প্রায় মৃত। কত শিল্প আর কত শিল্পী নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখার দ্বায়িত্ব তো আমাদেরও! হয়ত প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা কেউ দিতে পারিনি, তাই আজ সমস্তটাই ধোঁয়াশা হয়ে গিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রের মাঝে শিল্পকে পিষে চলেছি আমরা। আর এইভাবেই হারিয়ে গিয়েছে কত পাঁচুবাবু আর মন্মথ দাস তার খোঁজ মেলে না।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – বঙ্গদর্শন
Discussion about this post