“দই-দই-ভালো দই” পাড়া জুড়ে হাঁকচ্ছে এক দইওয়ালা। আর রুগ্ন অসুস্থ ছোট্ট অমল ঘরে আটকা পড়ে উপভোগ করছে সেই দৃশ্য। রবিঠাকুরের হাত ধরে দই সেদিন মিষ্টির দোকান থেকে জায়গা করে নিয়েছিল বইয়ের পাতায়। কারণ সেই অমল ও দইওয়ালাকে বাঙালি ভুলবে না কোনোদিন। তবে ‘দই’ শব্দটি উচ্চারণে যতখানি ক্ষুদ্র তেমনই বড় মাপের এর সংসার। ক্ষীরসা দই, রাজাপুরের দই, শাহী দই, শ্যামলের দই, শেরপুরের দই, রনি মিষ্টান্ন ভান্ডারের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দই এমন হাজার রকমের দই রয়েছে দুই বাংলার মিষ্টান্ন পরিবারে। তবে শুধুই দোকান নয় আপনারা জানলে অবাক হবেন শুধুমাত্র দইয়েরই আস্ত একটি মেলা বসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের চলনবিল অধুষ্যিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশে প্রতিবছর সরস্বতী পূজায় রকমারি দইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন দইওয়ালারা।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার প্রবীণ ব্যাক্তি সৌরেন্দ্র নাথ ঘোষ জানান, প্রায় আড়াই’শ বছর আগে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার পরম বৈঞ্চব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দই মেলার প্রচলন করেছিলেন। সাধারণত জনশ্রুতি আছে তৎকালীন পরম বৈঞ্চব জমিদার রাজা রায় বাহাদুর দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। এ ছাড়া জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করা হতো। আর সে থেকেই জমিদার বাড়ির সম্মুখে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দই মেলা বসতো। প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দই মেলায় বাংলাদেশের বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর থেকে ঘোষেরা দই এনে মেলায় পসরা বসিয়ে বিকিকিনি করতেন। কথিত রয়েছে সবচেয়ে ভালো সুস্বাদু দই তৈরি কারক ঘোষকে জমিদারের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়ার রেওয়াজও ছিলো। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের রণজিত ঘোষ ও রাজাপুর গ্রামের সুধীর ঘোষ বলেন, ‘৫০ বছর ধরে এই মেলায় দই বিক্রি করে থাকি। গতবছর ৪০০ হাঁড়ি দই আনা হয়েছিল। কিন্তু দুপুর ১২টার মধ্যেই সব দই বিক্রি হয়ে যায়’। এই দইমেলা উপলক্ষে মুসলিম-হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের পরিবারের জামাই, বউসহ আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করা হয়। বিভিন্ন প্রকার দই দিয়ে চলে তাঁদের আপ্যায়ন।
মেলা মানেই এক সম্প্রীতির ক্ষেত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণের বাছবিচার না করে একসাথে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠা। আর সেটি যখন দইয়ের মতো এক আমুদে খাদ্যকে ঘিরে হয় তখন তার মাহাত্ম্যই আলাদা মাত্রা এনে দেয়। এপার ওপার দুই বাংলার কাছেই এভাবেই দই স্বাদে আহ্লাদে ধরে রেখেছে তার ঐতিহ্যকে।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ
চিত্র ঋণ – alokitosirajgonj, kholakagojbd
Discussion about this post