কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মেই দীপাবলী বদলেছে তার রূপ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে থেকেই দেশে কালী পুজো প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই সময় দীপাবলি সীমাবদ্ধ ছিল মাটির প্রদীপের আলোক সজ্জার মধ্যেই। কারণ, দীপাবলি ছিল মূলতঃ পশ্চিম ভারতীয় উৎসব। সেই মাটির প্রদীপে কখনও ব্যবহৃত হত সরষের তেল, কখনও বা রেড়ির তেল, কখনও ঘি। এরপর আসে গ্যাসের বাতি। ধনীরা সেকালে আলোকসজ্জার সমারোহে ব্যয় করতেন হাজার হাজার টাকা! এ নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতাও। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ অতুল সুরের লেখনী থেকে জানা যায়, কলকাতার অনেক বাবুদেরই নাকি শখ ছিল বারবনিতাদের ঘরে গিয়ে বাজি পোড়ানোর! বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসটিতে এমনই কিছু দৃশ্যের উল্লেখ আছে। যেমন, কালীপুজোর রাতে এক বাবুর এক রক্ষিতার বাড়ির ছাদে মাদুর পেতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের আসর, তুবড়ি জ্বালিয়ে পতিতাপল্লীর অন্য বাবুদের সঙ্গে রেষারেষি ইত্যাদি!
এরপর কোম্পানির আমলে দীপাবলীর সমারোহে যুক্ত হয় বিভিন্ন ধরনের আতসবাজি। সাধারণত এই সব বাজি তখন আসত বাংলার বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে, যেমন লক্ষ্ণৌ! পলাশির যুদ্ধের কয়েক বছর পর জনৈক বাজিওয়ালা মইনুদ্দি কোম্পানির কাছ থেকে বাজি তৈরির লাইসেন্স নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কালীচরণ সিংহ নামে আরও এক বাজিওয়ালার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাজির কারিগররা ছিলেন মুর্শিদাবাদের অধিবাসী। দীপাবলী ছাড়াও সে সময় কলকাতায় আয়োজিত দেশী-বিদেশী ভোজসভা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিনোদনের জন্য আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হত। গার্ডেনরিচে মেনউইক নামে এক সাহেবের বাগানবাড়িতে বসত মেলা। সেখানে মূল আকর্ষণই ছিল বাজির বিভিন্ন কসরত আর খেলা! এ ছাড়া অনুষ্ঠিত হত বাজির প্রদর্শনীও।
পলাশির যুদ্ধের সময় কলকাতার বেশির ভাগ বাড়িতেই ছিল খড়ের ছাউনি। তাই নিরাপত্তার কারণে সেই সময় হাউই বাজি ছিল নিষিদ্ধ। শিমুলিয়ায় চড়কের মাঠে বিক্রি হতো তুবড়ির খোল। কালীপুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই ঐ মাঠে শুরু হতো বাজি পোড়ানো। এছাড়া প্রচুর ফানুসও ওড়ানো হতো। কারিগরদের কেরামতিতে রাতের আকাশে বিভিন্ন জীবজন্তুর চেহারা নিত সে সব ফানুস। কখনও বা আলোর লেখনীতে ফুটে উঠতো – ‘গড সেভ দ্য কিং’! পরে অবশ্য কলকাতায় আতসবাজির তালিকায় হাউইও ঢুকে পড়ে। এমনকি শুরু হয় হাউইয়ের প্রতিযোগিতাও। উচ্চবিত্তরা তখন অর্ডার দিয়ে পছন্দমত বাজি তৈরি করাতেন। মফঃস্বলের বহু মানুষ কলকাতায় আসতেন বাজি পোড়ানো উপভোগ করতে। বাজি পোড়ানো নিয়ে বর্তমান কালের মতো উন্মাদনা, রেষারেষি বা অন্যান্য হাঙ্গামা সে সময়ও যে বিরল ছিল না – সে কথা তো বলাই বাহুল্য!
তথ্য ঋণ – সেকালের কলকাতায় দেওয়ালি / অমিতাভ চক্রবর্তী – যুগান্তর, ২৭-১০-১৯৮১।
Discussion about this post