বেশ কয়েক বছর ধরেই ‘রামনবমী’ বলতে আমাদের চোখে ভাসে গেরুয়া তিলকধারণ করে অস্ত্র-শস্ত্রের মিছিল আর ‘জয় শ্রী রাম’-এর হুঙ্কার। বাংলায় যেমনটা আগে দেখা যেত না। জয় শ্রী রাম’ বাংলা কেন বাল্মীকির মূল রামায়ণ থেকেও আসেনি। এই শব্দবন্ধগুলো রাম চরিত্রটি রাজনৈতিক হাতিয়ার করার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই আনা হয়েছে। সংখ্যালঘু ছেলেকে পিটিয়ে মারার সময়, মুসলিম মেয়েকে ধর্ষণের সময়, দাঙ্গার সময় বলা ‘ জয় শ্রী রাম’-এর ব্যবহার খানিকটা বাংলায় ‘দেখ কেমন লাগে’-র মতোই।
তার মানেই কি ‘রাম’-এর সঙ্গে বাংলার একেবারেই কোনো পূর্বযোগ নেই? না, সে কথাও সত্যি নয়। প্রাক-চৈতন্য কালের বৈষ্ণব ধর্ম ছিলো মূলতঃ রামকে কেন্দ্র করেই। ঘটি বা এপাড়ের বাঙালীদের কূলদেবতা হিসেবে রঘুবীরের পুজোর প্রচলন ছিলো। বাঙালির রাম কৃত্তিবাসী রাময়ণের ভক্তিরস ও রাজরস সমৃদ্ধ রাম। বাঙালী রাম রামানন্দ সাগরে বা ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’-র অস্ত্রধারী ‘মাসলম্যান’ নন। বাংলার ‘অযোধ্যা রামের রাম’-এর সঙ্গে পেশীবহুল, নীল গাত্রবর্ণের রাম-এর মিল নেই। ‘অযোধ্যারামের রাম’ কে? হাওড়া, হুগলী, কলকাতার লোকজন হাওড়ার ‘রামরাজাতলা’ নামটার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। এই রামরাজাতলাতেই রয়েছে ‘অযোধ্যা রামের রাম’ বা রামরাজার মন্দির।
প্রায় ৩০০ বছর আগে হাওড়ার এই অঞ্চলে রাম পুজো শুরু হয়। এলাকার জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরি স্বপ্নাদেশ পেয়ে একটি বিশাল রাম-সীতার মূর্তি তৈরী করে পুজো শুরু করেন। স্বপ্নাদেশে রাম-সীতাকে তিনি রাজবেশে দেখেন, ফলে মূর্তিও তৈরী হয় তেমনি। এই রাম-সীতার মুখাবয়বে পুরোদস্তুর বাঙালীয়ানা, বাঙালী রাজাদের মতোই রামেরও রয়েছে একটি পুরুষ্টু গোঁফ। অযোধ্যারাম যেহেতু শিবভক্ত ছিলেন, তাই রাম-সীতার মূর্তির পাশে শিবের মূর্তিও থাকে। এছাড়াও রয়েছে হনুমান, ব্রহ্মা, জাম্বুবান, বিশ্বামিত্র, ভরত, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ ও বশিষ্ঠ।সে সময় ওই এলাকায় বারোয়ারি সরস্বতী পুজো চালু থাকায় রামপুজো নিয়ে এলাকাবাসীদের মধ্যে গোল বাঁধে, তার সমাধানে অযোধ্যারাম রামের মূর্তির ওপরে সরস্বতীর মূর্তি স্থাপন করেন। সেই থেকে রামপুজোর কাঠামো তৈরীর বাঁশপুজো চালু হয় সরস্বতী পুজোর দিন। রাম ঠাকুরের পুজো শুরু হয় রামনবমীর দিন,চারমাস পরে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার শোভাযাত্রা করে হয় বিসর্জন। রামরাজার পুজো ঘিরে চলে মেলাও।
এই এলাকার মানুষের কাছে ‘রামচন্দ্র’ বা ‘রামলালা’ নয় , ‘রামরাজা’ই তাদের ভগবান। বাঙালী চিরকালই আরাধ্য দেবতাদের ঘরের ছেলে বা ঘরের মেয়ে ভাবতেই ভালোবাসে। ঠিক যেমন- ‘ বুড়োশিব’, ‘কানু ছোঁড়া’, ঘরের মেয়ে ‘উমা’ তেমনি এই ‘ রামরাজা’। এই কারনেই ওই এলাকার নাম ‘ রামরাজাতলা’। কিন্তু বছর তিনেক আগে এই তিনশো বছরের ইতিহাসে একটু চিড় ধরেছে বা ধরানো হয়েছে। আগের রাম-সীতার মূর্তি তো বছর বছর বিসর্জন করা হতো। তাই সম্প্রতি পুরোনো মন্দিরের উল্টোদিকে পুকুর বুঝিয়ে নতুন মন্দির তৈরী হলো , স্থায়ীভাবে রাম-সীতা মূর্তি রাখা হলো। রাজস্থান থেকে আনা শ্বেতপাথরের মূর্তিতে নেই বাঙালীয়ানার ছাপ, নেই রামরাজার বিশাল গোঁফ, গাত্রবর্ণেও বদল,নেই চারপাশে থাকা অন্যান্য মূর্তিগুলিও। রাম-সীতার মুখাবয়বে হিন্দী বলয়ের ছাপ স্পষ্ট। আসল ‘রামরাজা’র মূর্তি দেখতে গেলে রামনবমী থেকে যে পুজো হয় সেইসময়ই যেতে হবে। চারমাসের মূর্তির পাশাপাশি স্থায়ীভাবে উত্তর ভারতীয় আর মূর্তি তৈরীর প্রয়োজনীয়তা কী কে জানে?
এই মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গেই তো জড়িয়ে এই জনপদের ইতিহাসও। তারমধ্যে অন্য সংস্কৃতি থাবা বসালে , ইতিহাসকে বদলে দিতে চাইলে নিজস্বতাটুকু পুরোটাই হারিয়ে যায়। ওই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান সবার ভালোবাসার ‘রামরাজা’ যদি বদলে গিয়ে বিধর্মী নিধনকারী, ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ পথপ্রদর্শক ‘ জয় শ্রী রাম’-এর রূপ ধরে তাহলে তার ভয়ের বৈকি!
Discussion about this post