বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামের ‘ডোকরা’ শিল্প,এই জেলার জনপ্রিয়তার অন্যতম মুখ। অতীতে দেবদেবীর মূর্তি থেকে হালফিলে গয়নার বাক্স, প্রবল ‘শিল্প রসবোধ’ সম্পন্ন ডোকরার প্রতিটি নিদর্শন। সৌন্দর্য্যের প্রতি মানুষের দুর্বলতা যেন একপ্রকার জিনঘটিত বিষয়। ডিএনএর কোনো নির্দিষ্ট কোড যেন তাকে বরাবর শিখিয়ে পড়িয়ে এসেছে সুন্দরকে অস্বীকার করা ভীষণ অন্যায়। সেই নান্দনিকতার খাতিরেই ডোকরা শিল্পের জন্ম সিন্ধু সভ্যতারও প্রাচীন সময়ে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোয় পাওয়া নিদর্শনের মধ্যে ‘নারীমূর্তি’ ডোকরা শিল্পের বিশিষ্ট উদাহরণ। তবে বাঁকুড়ায় এই শিল্পের প্রচলন সে অর্থে শুরু হয় প্রায় ১৫০ বছর আগে। ইতিহাস বলছে মধ্যপ্রদেশ থেকে ঝাড়খন্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আগমন ডোকরার। তারপর রাঢ়বাংলায় এর বেশ জমিয়ে পসার ঘটে। বাঁকুড়া জেলা তাদের মধ্যে অন্যতম। ডোকরা শিল্পী যুদ্ধ কর্মকারের সৌজন্যে বিকনা গ্রামের জনপ্রিয়তার ঝুলিতে এসেছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও। তাতে যেন মানুষের কাছে এর চাহিদা আরও তুঙ্গে ওঠে খানিক।
বিকনা গ্রামের ৬৫টি পরিবার এখনো বহন করে নিয়ে চলেছে তাদের গর্ব এবং ঐতিহ্য। গ্রামের মহিলা-পুরুষ সমান ভাবে হাত মিলিয়ে তৈরী করে এক একটি নিদর্শন। পুকুর থেকে মাটি সংগ্রহ করে আকৃতি দেওয়া হয় অবয়বের। তারপর ওপর পড়ে তেল আর মোমের প্রলেপ।শেষে নরম মাটির আস্তরণ দেওয়া হলে, তা পোড়ানো হয় আগুনে। এই তাপে গলে যায় মোমের আচ্ছাদন। সেই স্থান ভরাট করা হয় গলানো পিতল দিয়ে। পরিশেষে বিশেষ কায়দায় ভেঙ্গে ফেলা হয় বাইরের মাটির আবরণ এবং হাতে পাওয়া যায় পিতলের ডোকরার কাজ। একসময় ডোকরার দেবদেবী, নারী পুরুষের মূর্তির প্রচলন ছিল ব্যাপক। ধীরে ধীরে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে গয়না থেকে আরম্ভ করে ঘর সাজানোর নানান শৌখিন দ্রব্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাইক্রো, স্মল এন্ড মিডিয়াম সাইজ এন্টারপ্রাইজেস তরফ থেকে ডোকরা শিল্পীদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ চুল্লিও। শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে এবং শিল্পীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই এই উদ্যোগ। প্রতিবছরই মিলন মেলা এবং হস্তশিল্প মেলায় ছোট-বড় দোকান সাজান ডোকরা শিল্পীরা। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও এই শিল্পের যথেষ্ট খ্যাতি। বাইরে থেকে আসতে থাকে নানান ছোট বড় অর্ডার। শিল্পীদের কাছে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে এই শিল্প।
তবে মহামারীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি ডোকরা শিল্পীরাও। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তরতরিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম।দাম বাড়ছে ডোকরা শিল্পের কাঁচামালেরও। লাভের মুখ তাই খুব একটা দেখতে পারছেন না এঁরা। দু’বেলা ভাত জোগাড়ের দুঃশ্চিন্তায় অবসাদ তাদেরও। কবে সেই বাজার আগের মতো হবে আপাতত তারই চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে। এগিয়ে আসুক সাধারণ মানুষ। যে শিল্প পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতি ছড়িয়েছে বাইরেও তাকে অক্ষুন্ন রাখা আমাদেরই দায়িত্ব।
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – ড. তিলক পুরকায়স্থ, রেডস সুব্রত, সিদ্ধার্থ
Discussion about this post